শনিবার , ২০ এপ্রিল ২০২৪

ঢিলেঢালা লকডাউনে যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না

আব্দুল লতিফ   শনিবার , ২৫ এপ্রিল ২০২০

বাংলাদেশেও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাস আক্রান্তের সংখ্যা। লম্বা হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। প্রায় সব জেলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে মহামারী কোভিড-১৯। দেশে এক দিনে আরও ৫০৩ জনের মধ্যে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ায় মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৬৮৯ জন। ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৩১ জন হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ৫ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। নতুন এ্ই ভাইরাস থেকে ‘নিজেকে বাঁচাতে, অন্যকে রক্ষা করতে’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে মানুষকে ঘরে থাকতে কঠোর আদেশ জারি করেছে সরকার। রাজধানীসহ সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সেনা সদস্যদের জোর তৎপরতা দেখা চোখে পড়ছে। তারপরও মানুষ মানছে না ঘরে থাকার নির্দেশ। মানছে না লকডাউনও। শহর বা মফস্বলের মূল সড়কগুলো ফাঁকা থাকলেও অলিগলিতে দেখা যাচ্ছে মানুষের জটলা। নিজের বা পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা না করে সামান্য প্রয়োজনেই প্রতিদিন ঘর থেকে বের হচ্ছেন অনেকে। ফলে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া এই মরণব্যাধিটির লাগাম টানা দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

লকডাউন ও সরকারের নির্দেশ অমান্য করে অনেকেই ফিরে গেছেন নিজ এলাকায়। অনেকেই ফিরেছেন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে, ফিরছেন এখনও। যাত্রীবাহী যানবাহন বন্ধ থাকায় লুকিয়ে ফিরছেন পণ্যবাহী গাড়িতে। এতে সারা দেশে রোগটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

গত ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ২৩ মার্চ সরকার প্রথম দফায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব অফিস বন্ধ রাখার পাশাপাশি সারা দেশে যানবাহন চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সরকার ছুটি বাড়াতে থাকে। সর্বশেষ লকডাউন বা ছুটির মেয়াদ ৫ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

প্রতিদিনই বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে মূত্যুর মিছিল। ছোট–বড় সব দেশের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়। মহামারী থেকে জান বাঁচাতে বিশ্ববাসী যে অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করেছে, তাতে ওষ্ঠাগত অর্থনীতির প্রাণ, যা পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি মহামন্দার দিকে। করোনাভাইরাস সংকট ২০২০ সালে বিশ্বের অর্থনীতিকে ৩ শতাংশ ছোট করে আনবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল- আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পর এমন সংকট বিশ্ব আর দেখেনি।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় চলমান লকডাউনে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তার কোনো সরকারি হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। তবে দিনে এই ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার কম নয় বলে তথ্য দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।

অতি সংক্রামক এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে দেশে লকডাউন চলছে। এসময় সব ধরনের কল-কারখানাসহ বাইরের সব কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। এই এক মাসে বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাথমিকভাবে তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ওই গবেষক দল।

তাদের হিসেবে, এই এক মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর পরে লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। গত ২১ এপ্রিল ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এই হিসেব দেন তারা।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেছেন, “২০১৮-২০১৯ সালের জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি বা চলতি ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা হিসাব করার একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। ক্ষতি প্রশমনে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতে হবে।”

প্রশ্ন হচ্ছে, কী সেই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। মানুষের জীবন বাঁচাতে, অর্থনীতিকে বাঁচাতে তথা বাংলাদেশকে বাঁচাতে কী পদক্ষেপ বা ব্যবস্থা নিতে হবে আমাদের?

এখন পর্যন্ত উত্তর একটাই। আর সেটা হচ্ছে, ঘরে থাকতে হবে; সাবধানে থাকতে হবে; সতর্ক থাকতে হবে; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ লকডাউন মানছে না। অনেক চেষ্টা করেও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে বের হচ্ছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।

তাহলে আবারও প্রশ্ন জাগে- কী করতে হবে এখন? এক্ষেত্রেও উত্তর একটাই ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। লকডাউন কঠোর থেকে কঠোরতম করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে অনুসরণ করতে হবে।

পুলিশ-র‌্যাব, সেনাবাহিনী, বিডিআর, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি-সবাইকে এক সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে। সব জায়গায় জনসমাবেশ যে কোনমূল্যে ঠেকাতে হবে। গ্রামে-গ্রামে এবং মহল্লায়-মহল্লায় স্বেচ্ছাসেবী টিম গঠন করে, ফোনে জনগণের সকল নিত্য প্রয়োজনীয় সার্ভিস ও ত্রাণ বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে। যাদের ঘরে খাবার নেই তাদের ঘরে খাবার পৌঁছে দিতে হবে।

কোভিড–১৯ মোকাবেলার এই যুদ্ধ পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উদাহরণ টেনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মনে রাখতে হবে, ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা ছিল দৃশ্যমান শক্তির বিরুদ্ধে আর এখন বিশ্বজুড়ে যে যুদ্ধ চলছে তা অদৃশ্যমান শক্তির বিরুদ্ধে। অতএব এই যুদ্ধের ভয়াবহতা অনেক বেশি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার ভয়াবহতা আমরা ইতোমধ্যে উন্নত বিশ্বে দেখতে পাচ্ছি।

আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে৷ আরও দেরি করলে জাতিকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হবে। এই ভাইরারের বিস্তার প্রতিরোধ করতে না পারলে প্রতিকার করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে আামাদের মত মধ্যম আয়ের এই দেশে।

সবাই মিলে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করতে হবে। লকডাউন কঠোর করতে হবে। সবাইকে সেটা মানতে বাধ্য করতে হবে। ঢিলেঢালা লকডাউন দিয়ে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে না।

 স্বাস্থ্যবার্তা থেকে আরোও সংবাদ

ই-দেশকাল

আর্কাইভ