বৃহস্পতিবার , ১৮ এপ্রিল ২০২৪

চাল চুরির ঘটনা: কীভাবে বদলে গেল টাঙ্গাইলের কালিহাতি?

সালেক খোকন   শনিবার , ২৫ এপ্রিল ২০২০

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শামীম আরা নিপা

দেশে চাল চোরের সংখ্যা কত? এ নিয়ে নানা মুখোরচর খবর ঘুরছে সোসাল মিডিয়ায়। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই দুর্দিনে সামর্থ্য অনুসারে মানুষ থাকছে মানুষের পাশে। অথচ এক শ্রেণি ব্যস্ত সরকারের চাল আত্মসাতে। যখন লিখছি তখনও গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন জেলার চাল-তেল চুরির সংবাদগুলো। চাল আত্মসাতে জড়িত বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে, কয়েকজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকেও বরখাস্ত করেছে সরকার। চাল চুরিতে যুক্ত থাকায় অভিযুক্ত কয়েকজন সরকারি দলের নেতাকেও দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ ও সরকারি সহযোগিতা দেওয়ার ক্ষেত্রে যেকোনও ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ৬৪ জেলার ত্রাণ কার্যক্রম তদারকিতে ৬৪জন সচিবকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে।

কিন্তু ব্যবস্থাপনার কোন দুর্বলতার কারণে প্রায় সকল দুর্যোগের সময়টাতেই চাল চুরির সুযোগটি ঘটছে, সেটি কি খোঁজার চেষ্টা করেছে সরকার? চাল চোরদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর পাশাপাশি ভবিষ্যতে চুরি বন্ধ করতে সরকারের উদ্যোগগুলো আসলে কী? এমন প্রশ্নগুলোও আলোচিত হচ্ছে মানুষের মুখে মুখে।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ঘরে থাকার আহ্বানের পাশাপাশি খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে সরকার দরিদ্রদের জন্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কিছুদিন আগে। প্রাথমিক অবস্থায় সারাদেশের পৌরসভাগুলোতে ডিলারদের মাধ্যমে ১০টাকা দরে চাল বিক্রির উদ্যোগ নেয় খাদ্য অধিদপ্তর। যাকে আমরা ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) বলছি। যা চলবে বেশ কয়েকমাস। বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধারকৃত চালগুলো মূলত এই খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিরই।

ওএমএস এর চাল বিক্রির পদ্ধতিটি কেমন? সেটি একটু জেনে নেওয়া দরকার। ওএমএস এর ডিলাররা একটি নির্দিষ্ট স্থানে সাইনবোর্ড বা ব্যানার টাঙ্গিয়ে দশ টাকা দরে চাল বিক্রি করবেন। লাইন ধরে মাস্টাররোলে নাম লিখে টিপসই দিয়ে চাল কিনতে হয় খেটে খাওয়া মানুষদের। এর ফলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সোস্যাল ডিসটেন্স নিশ্চিত করা একেবারেই সম্ভব হয় না। একইসঙ্গে টিপসই নেওয়ার ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে সবচেয়ে বেশি।

ওএমএস এর চাল বিক্রি হয় সপ্তাহে তিনদিন। এ পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি তিনদিনই চাল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়াতে পারে। তাকে চিহ্নিত করার সুযোগ থাকে না। ফলে যার লাইনে দাঁড়ানোর জোর থাকে সে বারবার চাল কিনতে পারে। বঞ্চিত হয় শ্রমজীবী, দুঃস্থ ও অসহায়রা। ডিলারদের কারসাজির মাধ্যমে এক বা একাধিক লোক অধিক পরিমাণ চাল কিনে সে চাল মজুদ রেখে অন্যত্র অধিক দামে বিক্রি করাও সুযোগ পায়। এতে সরকার যে প্রকৃত উপকারভোগির কাছে খাদ্য সাহায্য পৌঁছাতে চায় সেটা বাধাগ্রস্ত হয় প্রবলভাবে। ব্যবস্থাপনার এ দুর্বলতার সুযোগটিই নেয় কিছু অসাধু ডিলার ও চাল চোররা। বিক্রির প্রচার তেমন না করে তারা নিজেদের লোকদের মধ্যে বিক্রি দেখিয়েও চাল আত্মসাৎ করেছে কোথাও কোথাও। ফলে করোনাকালে সরকারের মহৎ উদ্যোগও প্রশ্নের মুখে পড়ছে।

এসব কারণে সরকার ঘোষণা দিয়েছে তালিকা করে চাল বিক্রির। কিন্তু তালিকায় নাম আছে, কিন্তু চাল পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগও বিস্তর।

চারপাশে যখন চাল নিয়ে এমন অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার খবর। তখন সুখবর এলো টাঙ্গাইলের কালিহাতি থেকে। সে খবর আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখায়। আশ্বস্ত হই এই ভেবে যে, সবকিছুই ‘নষ্টদের দখলে’ চলে যায়নি এখনও।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের মাঝে সরকারের চাল বিক্রি শতভাগ নিশ্চিত করতে সেখানকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম আরা নিপা উদ্যোগী হয়ে প্রয়োগ করেছেন ডিজিটাল পদ্ধতি। তালিকায় যাদের নাম আছে তাদের হাতে তিনি তুলে দিয়েছেন কিউআর কোড সম্বলিত একটি ডিজিটাল কার্ড। উপকারভোগিরা ওই কার্ড নিয়ে ডিলারের নিকট এলে তা মোবাইলের নির্দিষ্ট অ্যাপের মাধ্যমে স্ক্যান করে চাল দেয়া হচ্ছে। এতে একই ব্যক্তি একাধিকবার বা নির্ধারিত পরিমাণের বেশি চাল নেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। অন্যদিকে খুব সহজে স্বল্প সময়ে তালিকাভূক্তদের হাতে চাল পৌঁছে যাচ্ছে। আবার মাস্টাররোলে টিপসই দিতে না হওয়ায় সামাজিক দূরত্বও নিশ্চিত হচ্ছে। এতে কারও চালবাজি বা একাধিকবার নেয়ার সুযোগ নেই। কারণ, যদি কারও কার্ড স্ক্যান না হয় তবে তার জন্য বরাদ্দকৃত চাল থেকে যাবে। অর্থাৎ, যিনি নেননি তার চাল ডিলারের কাছেই সংরক্ষিত থাকবে। আর এই হিসেব প্রতি মূহুর্তে অনলাইনে যথাযথ কর্তৃপক্ষ নজরদারি করতে পারবেন। এ পদ্ধতির সুফল এলাকার প্রায় আড়াই হাজার মানুষ পেতে শুরু করেছেন। যার সূচনা হয়েছে গত রবিবার থেকেই।

কীভাবে এটি সম্ভব হলো সেখানে? বিসিএস প্রশাসনের ২৯ ব্যাচের ওই কর্মকর্তা বললেন ঠিক এভাবে- “প্রযুক্তি জ্ঞান ছিল বলেই সে পথে সমাধানের চিন্তা করি। শুরুতে ভেবেছি সাদামাটা কোন কার্ড থাকবে। কিন্তু সেই ধরনের কার্ড খুব সহজেই নকল করা সম্ভব। তখন মাথায় এলো কিউআর কোড সম্বলিত ডিজিটাল কার্ড করার। প্রতি কার্ডে খরচ পড়েছে ১০-১২ টাকা। তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধি ছাড়াও ফেসবুকে গুগল ফরমের মাধ্যমে ব্যক্তির নাম, ফোন নম্বর, এনআইডি, ঠিকানা প্রভৃতি তথ্য সংগ্রহ করেছি। এভাবে বাছাই করে একটি তালিকা তৈরি করি আমরা। এ কাজে স্থানীয় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা ভীষণ আন্তরিক ছিলেন।”

“স্থানীয় কলেজ পড়ুয়া ছেলে আল আমিন। নিজের আগ্রহ থেকে বাড়িতে বসে ইউটিউব দেখেই অ্যাপ তৈরির কাজ শিখেছেন। এরইমধ্যে বেশ কয়েকটি অ্যাপ তৈরি করে প্রশংসাও পেয়েছে আল আমিন। তাকেই কাজে লাগানোর উদ্যোগ নিই। চাল বিক্রির সমাধান হিসেবে আলোচনা ও সুবিধাগুলো পর্যালোচনা করে খুব অল্প সময়েই আমরা একটি অ্যাপ তৈরি করে ফেলি। তবে এ কাজে আল আমিনের মতো তরুণরা এগিয়ে এসেছিল বলেই কাজটি করা সহজ হয়।”

অ্যাপ প্রস্তুতকারী আল আমিন
“প্রথমে উপকারভোগিদের তালিকা সিসটেমে আপলোড করে, কার্ড প্রিন্ট করা হয়। জনপ্রতিনিধিরা সেই কার্ড সবার নিকট পৌঁছে দেন। ডিলাররা অ্যানড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে অ্যাপে একবার লগ ইন করেই কার্ডের কিউআর কোড স্ক্যান করে চাল বিক্রি করা শুরু করেন। প্রতিদিন কত কেজি চাল, কার কার কাছে বিক্রি করলো, সেটাও অনলাইনে দেখে নেওয়া যায়। ফলে ডিলারের পক্ষে কার্ড ছাড়া অন্যত্র চাল বিক্রির সুযোগ নেই। প্রতি কেজি সরকারি চালের সঠিক ডিসট্রিবিউশন এই ডিজিটাল পদ্ধতিতে নিশ্চিত করা সম্ভব।”

শুধু ওএমএস-এর চালই নয়, সরকারের ত্রাণ সংশ্লিষ্ট সকল কর্মসূচিতেই ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করা সম্ভব। সেটা করা গেলে যেমন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে, তেমনি সরকারের নানা ব্যয়ও কমে আসবে। পাশাপাশি সরকারের কাছে উপকারভোগিদের ডেটা সংরক্ষণ থাকলে কর্মসূচি যাচাই ও নতুন পরিকল্পনা গ্রহণও সহজ হবে। এতে সরকারি খাদ্য সহযোগিতা সঠিক ব্যক্তিটি সঠিকভাবে পেতে পারবেন। চুরির কোন সুযোগ থাকবে না। এমনটাই মত দেন প্রযুক্তি সংশ্লিষ্টরা।

সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছে। কিন্তু তার সুফলটা তৃণমূলের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই বড় কাজ। বর্তমান সময়ে শামীম আরা নিপার মতো একজন ইউএনও চাল চুরি ঠেকাতে যখন ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নেন তখন আমরা সত্যি আশাবাদী হই। কিন্তু আমাদের প্রশ্নের তীরটি তখন চলে যায় সরকারের তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং এটুআইএ-র দিকে। তাদের মাধ্যমে কোটি টাকা ব্যয়ে শত শত অ্যাপ তৈরি খবর আমরা পাই। কিন্তু তার কতটি জনসাধারণের জন্য কতটুকু কাজে এসেছে? বর্তমান সময়ে উল্লেখিত আইডিয়াগুলো তো তাদের কাছ থেকেই আসা উচিত। তাহলে কি ওএমএস ও ত্রাণ সংশ্লিষ্ট জায়গায় ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহারের বিষয়টি তাদের কাছে উপেক্ষিত ছিল?

সরকার হয়তো কালিহাতির আইডিয়া থেকেই সারাদেশে ওএমএস-এর চাল বিক্রিতে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা মনে করি সারাদেশে এটি করতে পারলে অধিক মানুষ সুফল লাভ করবে। তবে যারা এ আইডিয়ার প্রবর্তন করলেন তাদেরও যুক্ত রাখা এবং আল আমিনের মতো মেধাবীদের প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি করে নেওয়ার দায়িত্বটিও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়। পাশাপাশি ত্রাণ সংশ্লিষ্ট সকল কাজগুলো কীভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সফল করা যায়, সেটি নিয়ে এখনই পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। চুরি বন্ধ করা আর সরকারি ত্রাণ ও খাদ্যসহযোগিতা প্রকৃত উপকারভোগীর নিকট পৌঁছে দেওয়াই এখন সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ। আর এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহারই আনতে পারে সফলতা।

 মুক্তবাক থেকে আরোও সংবাদ

ই-দেশকাল

আর্কাইভ