নুরুল আমিন:
পৃথিবীর সবচাইতে পুরানো শিল্পখাতের মধ্যে একটি হচ্ছে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহন বা শিপিং। পণ্য পরিবহনের জন্য বিশ্বের অর্থনীতি প্রায়সম্পুর্নরূপে শিপিং নির্ভর। শিপিং বানিজ্যের মুল দিকটি হচ্ছে কম জ্বালানী খরচ করে সাশ্রয়ী ব্যয়ে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এক সাথে ব্রেকবাল্ক (খোলা) বা কন্টেইনারে অধিক পরিমানে পণ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করার সুবিধা ।সে কারনে শিপিংকে বর্তমান বিশ্বে আন্তর্জাতিকবাণিজ্যের একটি মৌলিক উপাদান বা বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বে সর্বমোট পণ্য পরিবহনের ৮০ থেকে ৮৫ভাগ পণ্য সমুদ্র পথে পরিবাহিত হয়ে থাকে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শিপিং এর চাহিদা বিবেচনা করে দক্ষ শিপিং সেবা প্রদান এবং দেশের সিংহভাগ আমদানী রফ্তানী পণ্য নিজস্ব জাহাজ বহর দিয়ে পরিবহনের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে বর্তমানে ব্রেকবাল্ক জাহাজের অপর্যাপ্ততা এবং কোনো কন্টেইনার জাহাজ না থাকায় বাংলাদেশ সমুদ্র পথে পরিবাহিত মোট পণ্যের সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ পরিবহন করতে সক্ষম। তাই বাংলাদেশে কন্টেইনারের মাধ্যমে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সমুদ্র পথে যে আমদানী-রফ্তানী পণ্য পরিবহন হয় তার ৯৫ শতাংশই বিদেশী জাহাজ কোম্পানীর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই সুযোগে বাংলাদেশে বর্তমানে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ১০টি সহ আরো বেশ কয়েকটি শিপিং কোম্পানী তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় এজেন্সি নিয়োগ সহ সরাসরি ও যৌথ অংশীদারিত্বে তারা এদেশে ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং সেই সুবাদে সমুদ্র পথে পণ্য পরিবহন বাবদ দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক কালে জাহাজের ভাড়া বাবদ প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা ওই সব বিদেশী জাহাজ কোম্পানীগুলো এদেশ থেকে নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ আমদানী-রফ্তানী কার্যক্রম ফ্রেইট ফরোয়াডিং সেবার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ফ্রেইট ফরোয়াডিং কোম্পানীগুলো আমদানীকারক ও রফ্তানীকারকদের পক্ষে জাহাজের পরিবহন ভাড়া বা ফ্রেইট নির্ধারন ও পরিশোধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। দুর্ভগ্যবশত: বর্তমানে দেশে পণ্য পরিবহনে বিদেশী মালিকানাধীন জাহাজ কোম্পানীগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের কারনে নির্দিষ্ট ভাড়ার বাইরেও কিছু কিছু শিপিং লাইন ফরোয়ার্ডারের কাছ থেকে ডকুমেন্টেশন চার্জ, বিএল চার্জ, বিএল সারেন্ডার চার্জ, লেট বিএলচার্জ, বিএল এক্সপোর্ট প্রসেসিং ফি, লোকাল ডকুমেন্ট ইডিআই চার্জ, সিল ফি, স্টাম্প ফি ইত্যাদি বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন হারে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডারের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে। এসব চার্জের অনেকগুলোই ফরোয়র্ডাররা শিপার, আমদানীকারক বা রফ্তানীকারকদের কাছ থেকে আদায় করতে পারছে না। অনেক সময় এসব চার্জের পরিমান একজন ফরোয়ার্ডারের একটি কন্টেইনারে অর্জিত আয়ের চাই্তওে বেশী। এটাও দেখা যাচ্ছে যে, সব শিপিং কোম্পানী সব চার্জ নেয় না এবং যারা যে চার্জ নেয় তাও একই হারে নেয় না। এতে প্রমান হয় যে এসব চার্জ আদায় করা একেবারই আইন সিদ্ধ নয়। শিপিং লাইন বা তাদের এজেন্টদের একচেটিয়া অন্যায় চার্জ আদায়ের ফলশ্রুতিতে অনেক ফরোয়াডিং কোম্পানী লোকসানের সম্মুখীন হয়ে দিন দিন দেউলিয়া হয়ে পড়ছে বা ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। দেশ হারাচ্ছে লজিষ্টিকস্ সক্ষমতা।
এর বাইরেও শিপিং অফিসগুলোর বিএল রিলিজের জন্য পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে বিলম্ব ফি আদায় করা, ফয়ার্ডারদের চেক গ্রহন না করে পে-অর্ডার ইস্যুর বাধ্যবাদকতা করে সময় ও খরচ বাড়ানো, তাদের নিজস্ব কাউন্টারে গিয়ে বিএল রিলিজ, সারেন্ডার বা ডেলিভারি অর্ডারের জন্য অনেক সময় অপচয় করতে হয়। অথচ শিপিং অফিসগুলো ইচ্ছা করলেই চেক গ্রহন করে অযাচিত সময় ও খরচ বাঁচাতে পারে। অথবা তারা প্রয়োজন মনে করলে এয়ারলাইন অফিসের মত একটি নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের ব্যাংক গ্যারান্টি নিয়ে রাখতে পারে এবং তার বিপরীতে অনলাইনে বিএল রিলিজ, সারেন্ডার বা ডেলিভারী অর্ডারের ব্যবস্থা করে উভয় পক্ষের সময় বাঁচাতে পারে।
এই পরিস্থিতি উত্তরণে এবং দেশের ফরোয়ার্ডারদের টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে নৌ পরিবহন মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপ অত্যন্ত জরুরী। বিষয়টির প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েশন (বাফা) থেকে ইতিমধ্যেই 'ডিজি শিপিং' বরাবরে চিঠি দিয়ে শিপিং কোম্পানীগুলোকে এসব অন্যায় অর্থ আদায় থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা জানানোর অনুরোধ করা হয়েছে। কারন ওইসব শিপিং অফিসগুলো যদি অন্যায়-অযৌক্তিকভাবে আরোপিত এসব চার্জ নেয়া বন্ধ না করে তাহলে ফরোয়ার্ডারদেরকে বাধ্য হয়ে শিপারদের কাছ থেকে এসব আদায় করতে হবে।তাতে করে শিপার বা রফ্তানীকারকদের সাথে ফরোয়ার্ডারদের ভুল বোঝাবুঝির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে দেশের আমাদানি-রফ্তানী কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়া সহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত রফ্তানী ব্যয় কমানোর নির্দেশনা বা প্রচেষ্টা ক্ষতিগ্রস্হ হতে পারে এবং বিশ্বে আমাদের রফ্তানীবাণিজ্য আরো কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে পারে। যা আমাদের কারোরই কাম্য হতে পারে না। তাই, এখনই এই ব্যপারে শিপিং কোম্পানীগুলোকে নির্দেশনা প্রদান জরুরি।
লেখকঃ ডাইরেক্টর – মিডিয়া ও পাবলিকেশন, বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স এসোসিয়েসন (বাফা) এবং ম্যানেজিং ডাইরেক্টর,টাওয়ার ফ্রেইট লজিস্টিকস লিমিটেড ।