এবার একটু অতীতের কথা বলি। ১৯৭৩ সালে সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানপ্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষকদের সরকারের পক্ষ থেকে বেতন-ভাতা প্রদানেরসিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে নানাক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সংকটথাকলেও তিনি এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা শিক্ষকদের ভাগ্যের পরিবর্তনঘটায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও সারা দেশে নানা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটসত্ত্বেও বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদেরসম্মান ও সম্মানী এবং শিক্ষকদের সম্মানীবাড়িয়ে তাদের জীবনমান উন্নত করার পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়হলেও বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষকদের নুন আনতেপান্তা ফুরায় অবস্থার অবসানে যথেষ্ট নয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার বহুবার শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্রবেতন কাঠামো প্রণয়ন ও উচ্চ বেতন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছে। ‘সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণেআওয়ামী লীগের রূপকল্প ২০২১ সাল কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই’ শীর্ষকপ্রবন্ধে ‘শিক্ষা’ উপ-শিরোনামেওবিষয়টি বলা হয়েছে। প্রবন্ধটিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছেযে: ‘‘২০১৪ সালে নিরক্ষরতা সম্পূর্ণ দূর, শিক্ষার মানোন্নয়ণে, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরিজ্ঞানসম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলা এবং শিক্ষকদের উচ্চতর বেতন সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।’’[‘ভিশন ২০২১’, ঘোষণাপত্র ও গঠনতন্ত্র,বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ঢাকা: ২০০৯,পৃ. ৫১] ২০১৪সালের নির্বাচনী ইশতেহার ও জাতীয় শিক্ষানীতিতেও ওই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়াহয়েছিল। ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতিতেও বলা হয়েছে: “আর্থিক সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সকল স্তরেরশিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে।” [পৃ.৫৮] এই সব প্রতিশ্রুতির সঙ্গে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৬৯তমঅধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর ‘অস্ত্র নয় শিক্ষায়বিনিয়োগ করার’ আহবান শিক্ষকদের আশান্বিত করেছিল যে,অচিরেই হয়তো তাদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রণয়ন করা হবে। কিন্তুপ্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারও জাতীয় শিক্ষানীতিতে থাকা সত্ত্বেও, পে-কমিশনের ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করা যাবে না’ মর্মে সুপারিশ সকল স্তরের শিক্ষকদের হতাশ করেছে।
বর্তমান সরকার প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেলহবে। কিন্তু আজো সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। বরং আমরা দেখেছি, আন্দোলনরতশিক্ষকদের ভাগ্যে জুটেছে মরিচের গুঁড়া। আমাদের দেশের প্রাথমিক স্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার প্রতিটি ধাপকে বিন্যস্ত করে সাজাতেহবে এবং সংস্কার করতে হবে। ‘থিওরি অ্যান্ডপ্রবলেম’ নামের বইটির অন্যতম লেখক ক্রিস্টোফার জে ব্রডলিরমৃত্যুর পর জানা যায়, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি শেষ১০ বছর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। গত বছর ৫ সেপ্টেম্বরব্রিটিশ দৈনিক ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, সুইজারল্যান্ডেসর্বোচ্চ বেতন ৬৮ হাজার ডলার। ওই দেশে এর পরের সর্বোচ্চ বেতন ৫০ হাজার ডলার।আমেরিকায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিযুক্ত হন বার্ষিক ৩৭ হাজার ৫৯৫ ডলারবেতনে। ১৫ বছর চাকরি করার পর ওই শিক্ষকের বেতন হয় ৪৬ হাজার ১৩০ ডলার। তারসর্বোচ্চ বেতন হতে পারে ৫৩ হাজার ১৮০ ডলার।
আমি স্বীকারকরছি, বাংলাদেশ আমেরিকা বা সুইজারল্যান্ড নয়। উন্নত দেশেরমতো বেতন দেয়া এ দেশে সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পাশে আছে পশ্চিমবঙ্গ,কথায় কথায় যাদের উদাহরণ আমরা দেখাই। বাংলাদেশে একজন শিক্ষকেরবেতন আর পশ্চিমবঙ্গের একজন শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। আসলে ব্রিটিশরা এদেশের শিক্ষকদের ললাটে অসম্মানজনক বেতনের যে অপমান লেপন করেছিল আজো তার অবসানহয়নি। সৈয়দ মুজতবা আলী রচিত পাদটীকা গল্পে পণ্ডিতমশাই তার ছাত্রদের যে গাণিতিকসমস্যার সমাধান করতে দিয়েছিলেন আজো সে ছাত্ররা তার সমাধান দিতে পারেনি।পণ্ডিতমশাইয়ের ছাত্ররা মন্ত্রী হন, অর্থমন্ত্রীহন, দেশের কর্ণধার হন কিন্তু পণ্ডিতমশাইয়ের গাণিতিক সমস্যারসমাধান করতে পারেন না।
মনে রাখতে হবে,সমাজের সব পেশাই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু শিক্ষকতাকেসব পেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে হবে না। উন্নত দেশের শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে সেসব দেশেরশিক্ষকের সামাজিক অবস্থান এবং অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকেও আমাদের অনুসরণ করতে হবে। শিক্ষাকেআধুনিক রূপ দেয়ার আগে শিক্ষককে আধুনিক এবং যুগোপযোগী করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাহাতে নিতে হবে। নিয়োগ শিক্ষাগত যোগ্যতা, আচরণবিধি,বেতন স্কেল, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাসবকিছু সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীর থেকে আলাদা করতে হবে। সমাজকে যেমন বুঝতে হবেমানুষ তৈরির জন্য শিক্ষকের অবস্থান অন্যদের চেয়ে আলাদা, তেমনিশিক্ষকের নিজেরও তার অবস্থান এবং মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
দেশ ও জাতির প্রয়োজনেইদেশের সবচেয়ে মেধাবী তরুণ-তরুণীদের জন্য খোলা রাখতে হবে ‘শিক্ষকতা’ পেশার দ্বার। ঈর্ষণীয় বেতন স্কেল,উন্নত জীবনমান এবং মর্যাদাসম্পন্ন অবস্থানই পারে মেধাবীদের এ মহানপেশায় আকৃষ্ট করতে। আর আমরা তো এটা সবাই জানি, শিক্ষার মানের ওপর শুধু একজন শিক্ষার্থীর নয়;একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের টিচার পেইঅ্যারাউনড দ্য ওর্য়াল্ড প্রবন্ধে বলা হয়েছে : আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থা আজকেরশিক্ষার্থীকে আগামী দিনের অর্থনীতির জন্য প্রস্তুত করে। একজন মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের প্রকৃত শিক্ষা প্রদান করতেপারে। আর মেধাবী শিক্ষার্থীরা তখনই শিক্ষকতায় আসবে, বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আগ্রহী হবে; যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চপর্যায়ের সম্মান ও সম্মানীপ্রদান করা হবে। উন্নত রাষ্ট্রগুলো এ বিষয়টি বহু আগে উপলব্ধি করেছে বলেই তাদেরশিক্ষাব্যবস্থা আমাদের থেকে বহু এগিয়ে রয়েছে।
শেষ কথা হলো,শিক্ষকরা পাঠদানে আরও বেশি করে মনোযোগী তখনই হবেন,যখন তাদের আর্থিক দুর্দশা থাকবে না। এটা কেউ চাইবে না যে,শিক্ষা খাতে অদক্ষদের লালন-পালন করা হোক। সেরাদেরই আনতে হবেশিক্ষক হিসেবে। সমাজের অন্য সব ক্ষেত্রেওএটাই কাম্য। আর তার জোগান আসতে পারে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেরা হিসেবে গড়েতুলতে পারলে। সহজ কথায়বলা যায়, শিক্ষাকে যুগোপযোগী এবং মানসম্মত করার জন্য,মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, সর্বোপরিসত্য কথা বলার মানুষ সৃষ্টির জন্য শিক্ষার আগে শিক্ষকের কথা ভাবতে হবে। শিক্ষকতাপেশায় দেশের সবচেয়ে মেধাবী এবং মননশীলদের সম্পৃক্ত করার জন্য এই পেশার মর্যাদা এবংবেতন স্কেল আলাদা করতে হবে।