রিকশা, অটোরিকশা, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক, নছিমন বা করিমন—খেটে খাওয়া মানুষের এই বাহনগুলো বরাবরই বহুমুখী নিপীড়নের শিকার এই দেশে। একদিকে এগুলো দেশীয় মেকানিকদের স্থানীয় উদ্ভাবন, অর্থাৎ প্রচলিত বাহনের মধ্যে পড়ে না। প্রাতিষ্ঠানিক সনদ নেই বা সহজ করে বললে ‘বুয়েট-পরীক্ষিত’ নয়। তার ওপর আবার এগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের বাহন। বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন বা জেলা প্রশাসন—কোথাও এসব বাহনের বৈধতার সনদ নেই। কিন্তু তাতে কী? থানা, পুলিশ, সরকারি ষন্ডা থেকে প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে চালকেরা নিয়মিত চাঁদা দেন। অনাবাসিক খাতে নিয়মিত বিদ্যুতের বিলও পরিশোধ করেন। আবার এসব বাহনের বিভিন্ন পার্টসের উৎপাদন, বেচাকেনা, ও অ্যাসেম্বলিংয়ের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কয়েক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান।
চাহিদাও কি নেই? খুদে বিক্রেতার পণ্য পরিবহন, অলিগলির ভেতরে যাত্রী বহন, গ্রামের মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া—এসব বিবেচনায় নিলে গ্রামাঞ্চলে, জেলা শহরে বা খোদ ঢাকা শহরেও এসব বাহনের বিপুল চাহিদা। আবার অপরিকল্পিতভাবে এর সংখ্যা বাড়ছে, তাই যানজটও বাড়ছে।
কিন্তু প্রশ্ন করুন, যানজটের দায় কার? শুধুই রিকশার? ঢাকার রাস্তায় আড়াই লাখ ব্যক্তিগত গাড়ি চলে। প্রতিবছর গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার প্রাইভেট কারের লাইসেন্স দিচ্ছে বিআরটিএ। মাত্র ৪ শতাংশ যাত্রী বহন করে রাস্তার ৭৫ শতাংশ জায়গা দখল করে থাকে এসব গাড়ি। ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোয় প্রশস্ত রাস্তার অভাব, সময় না মেনেই বাস-ট্রাকের অবাধ চলাচল, গণপরিবহনের ভগ্নদশা—এসব মিলিয়ে যানজটের কারণ বহুমুখী। কিন্তু খুব সহজেই গরিবের এই বাহনগুলোর দিকে আঙুল তোলা হয়। বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে।
লক্ষ করুন, এই মাসে ঢাকায় আউডি এসেছে ৫৮টি। ভবিষ্যতে আরও শ খানেক আসবে। হাই-এন্ডের কিউ ৩, কিউ ৭ মডেলের আউডি ৯০ লাখ থেকে আড়াই কোটি টাকা পর্যন্ত প্রাইস ট্যাগ—কে চালায়, কে আমদানি করে, কে কেনে? তিনি কি বৈধ? এনবিআর প্রকাশ করুক তাঁদের বৈধতার ট্র্যাক রেকর্ড। রাস্তার ৭৫ শতাংশ দখল করে আউডি চলবে, প্রিমিও চলবে, প্রাডো চলবে, আর বৈধ-অবৈধর প্রশ্ন উঠবে কেবল আধপেটা কৃষকের সন্তান রিকশা চালিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচতে চাইলে? কয়েক সেকেন্ডের নোটিশে বগুড়ার সাইফুলের অটোরিকশাটি ভেঙে ফেলেছে যে বীর বাহাদুর বুলডোজার হাতিরঝিলে বিজেএমইএ ভবনের বেলায় তার হাঁটু কাঁপে কেন? কেন ভবন অপসারণের সময় মাস-বছর পেছানো হয়?
অটোরিকশা বিপজ্জনক?
অটোরিকশায় দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। রিকশার বডির সঙ্গে মোটরের গতির সামঞ্জস্য নেই। এটি খুবই যৌক্তিক অভিযোগ। কিন্তু রিকশা যেহেতু একটি বাস্তবতা, আপনি চান বা না চান, চাহিদা-জোগানের নিয়ম অনুসারেই এই বাহন যেহেতু শহরে ও গ্রামাঞ্চলে লাখে লাখে ছড়িয়ে পড়েছে এবং এমপি সাহেবের প্রাডোর চেয়ে সাইফুলের অটোরিকশা যেহেতু কম জায়গা নিচ্ছে, রিকশার আধুনিকায়ন ও অটোমেশন তাই সময়ের দাবি হয়ে উঠছে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে বডির ভরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্দিষ্ট গতির উপযোগী মোটর স্থাপনের কাজটি করতে পারতেন এ দেশের সরকারি প্রকৌশলীরা। কয়েকটি ফিল্ড টেস্টের মাধ্যমেই এই নিরীক্ষা করা সম্ভব। দীর্ঘ মেয়াদে রিকশার পুরো কাঠামোকেই নিরাপদ ও দ্রুতগতির উপযোগী করে তোলা সম্ভব ছিল। প্রশ্ন করতে চাই, এত দিনেও এই আধুনিকায়নের কাজটি হয়নি কেন? স্থানীয় মেকানিকদের প্রচেষ্টা এবং ধোলাই খালের উদ্ভাবনী শক্তির সঙ্গে কেন যুক্ত হতে পারেনি প্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রকৌশলের জ্ঞান? গরিবের বাহনের উন্নয়নে ও আধুনিকায়নে দেশের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলো এগিয়ে আসেনি কেন? শত বছর ধরে গায়ে-গতরে খেটে, ঘাম ঝরিয়ে, প্যাডেল ঠেলে ঠেলেই রিকশা চলবে? আমাদের নগরজীবনকে প্রতিনিয়ত ‘সেবা’ দেওয়া যোগাযোগের এই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বাহনটিকে কখনোই স্বয়ংক্রিয় হতে দেওয়া হবে না? যতটুকু জানি, এমআইএসটির (Military Institute of Science and Technology) উদ্যমী কিছু তরুণ সৌরবিদ্যুৎভিত্তিক অটোরিকশার একটি অভিনব ডিজাইন তৈরি করেছিলেন, কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এমন সৃজনশীল প্রকল্পটিও ‘ম্যাস মার্কেটিং’-এর মুখ দেখেনি।
বিদ্যুতের অপচয়?
অতঃপর তাঁরা বলবেন, দেশে বিদ্যুতের সংকট। ব্যাটারিচালিত রিকশায় বিদ্যুতের অপচয় হয়। তাই কি? বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের একটি রাজনীতি আছে। আমাদের শেখানো হয়, উচ্চবিত্তের বিলাসী বিদ্যুতের ব্যবহার বৈধ। এয়ারকন্ডিশন বৈধ। লাইটিং বৈধ। তবে দুই টাকার রিকশাচালক ব্যাটারি লাগাতে পারবেন না। এটা অবশ্যই বিদ্যুতের অপচয়! এবং অবৈধ।
ভারতীয় সাংবাদিক পি সাইনাথ একবার হিসাব করে দেখিয়েছিলেন, মুম্বাই শহরের শপিং মলগুলোয় যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, তা দিয়ে মহারাষ্ট্রের শত শত প্রান্তিক গ্রামকে আলোকিত করা সম্ভব। বাংলাদেশেও বিদ্যুতের আসল অপচয়টি কে করছে, তা খেয়াল করুন। বসুন্ধরা শপিং মলের প্রায় আড়াই হাজার দোকানে কানেক্টেড লোড আছে কমপক্ষে ১০ মেগাওয়াট। অন্যদিকে, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি জেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পিকলোড সরবরাহ খুব বেশি হলে টেনেটুনে ১৬ মেগাওয়াট। অর্থাৎ, একটি গোটা জেলার মোট সরবরাহের অর্ধেকের বেশি লোড লাগিয়ে বসে আছে ঢাকা শহরের একটি মাত্র শপিং মল!
এ ছাড়া ঢাকা শহরের মেগা মলগুলোয় বিপুল বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হয় বিকেল পাঁচটার পর থেকে। অর্থাৎ, পিকলোডের সময়। ঠিক এই সময়েই নগরের বাড়তি বিদ্যুতের জোগান দিতে কুইক রেন্টালগুলো থেকে ১৮ টাকা দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে সরকারকে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে চলছে মেগা সিটির ‘শৌখিন’ বিদ্যুতের সরবরাহ। অথচ জেলা শহরের একজন অটোরিকশাচালকের ব্যাটারি চার্জ করার নির্ধারিত সময় রাত ১২টার পর। অর্থাৎ, ‘অফ পিক’ টাইম। এই সময়ে বিদ্যুতের চাহিদা এমনিতেই কম। অপচয়ের সুযোগ নেই।
বহু বছর আগের একটা সেচ পাম্পের বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ে? ‘ও বাজান, রাত ১১টা বাজে, পাম্প চালু করো’? কৃষকের পাম্প চালানোর জন্য রাষ্ট্রের নির্ধারণ করে দেওয়া সময়টিও খেয়াল করুন। রাত ১১টার পর। অর্থাৎ, ‘পিক আওয়ারে’ মৌতাতে থাকবে মেগাসিটি, আর সারা দিন মেহনত করা গ্রামের কৃষক বা মফস্বলের রিকশাচালক, গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে থেকে পাম্প চালাবে, ব্যাটারি চার্জ দেবে!
অতঃপর বিদ্যুৎ অপচয়ের মিথ্যা অপবাদটিও তার ঘাড়ে এসেই পড়বে?
বৈধ-অবৈধর জারিজুরি
আসল কথা হলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি। কর্মসংস্থান নেই, বেকারত্ব বাড়ছে, গণপরিবহনের বেহাল দশা, রাস্তায় চাহিদা আছে বাহনের, তাই ধার-কর্জ করে, জমি বিক্রি করে দুই পয়সা কামাই করতে রাস্তায় নেমেছে অগণিত বেকার। প্রতিটি জেলা শহরেই আছে ৩০ থেকে ৪০ হাজার ‘অবৈধ’ বাহন। অসংখ্য বাহন যখন রাস্তায় চলছে, দরিদ্র মানুষ কামাই করে খাচ্ছে এবং সরকারি পান্ডাদের নিয়মিত চাঁদাটুকু পর্যন্ত দিচ্ছে, তখন কলমের এক খোঁচায় গুঁড়িয়ে দেওয়া যায় এতগুলা মানুষের জীবন-জীবিকা? ন্যূনতম বিকল্প আয়ের ব্যবস্থা না করেই? প্রশাসনের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রতিটা স্তরে ক্ষমতার দম্ভ কতটুকু মাথাচাড়া দিলে এমন অমানবিক, ধ্বংসাত্মক, গণবিরোধী বুলডোজার চালানো সম্ভব?
বগুড়ার প্রথম আলোর প্রতিনিধি আনোয়ার পারভেজ জানালেন, বগুড়ার আঞ্চলিক পরিবহন কমিটির সভায় দুদিন আগে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, অবৈধ অটোরিকশা জব্দ হবে। ৩০০ অটোরিকশা নাকি আগেই আটক করা হয়েছে এবং পৌরসভার হেফাজতেই ওগুলোর ব্যাটারিও নাকি ইতিমধ্যে চুরি হয়ে গেছে। খেয়াল করুন, বগুড়ায় ইজিবাইক আছে, থ্রি-হুইলার আছে, অটোরিকশাও আছে। বগুড়া শহরের শোরুমগুলোয় নিয়মিত বিক্রিবাট্টাও চলছে। ইজিবাইকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে যুবলীগ। কাজেই এগুলোর গায়ে টোকা দেওয়া যাবে না। অটোরিকশাগুলো থেকে এত দিন চাঁদা তুলেছেন যুবলীগের তুফান সরকার। কাজেই এত দিন বৈধতার প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু এখন উঠছে! কেন?
ফোনে কথা হয় অটোরিকশাচালক সাইফুলে সঙ্গে। তাঁর ভাষায়, ‘এগার শ টাকা দিয়ে কার্ড বানাইছিলাম, পরে দিছি চব্বিশ শ টাকা। তুফান সরকার কইছে, তার থেইকা কার্ড নিলে রিকশা বৈধ।’ বোঝা গেল, তুফান সরকার এই দেশের সরকার। তা সরকার এখন কোথায়? ধর্ষণ করে জেলে গেছেন। বগুড়া শহরে অটোরিকশা চলছে, অথচ যুবলীগ, ছাত্রলীগ টু পাইস কামাচ্ছে না? কী কাণ্ড! ভাঙো, গুঁড়াও। বুলডোজার দিয়ে রুগ্ণ, ক্লিষ্ট, হাড়ভাঙা মানুষগুলোর জীবিকার শেষ সম্বলটুকু ছাতু বানিয়ে দাও। এই দেশের নাম বাংলাদেশ। সব চলে।
নিয়ম অনুসারে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসার কথা ছিল। চালকের নাম-ঠিকানা টুকে রাখার কথা ছিল। ঘটনাস্থলে ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত ছিলেন, পুলিশের বড় কর্তারা ছিলেন, এমনকি স্বয়ং মেয়র উপস্থিত ছিলেন। এখন ক্ষতিপূরণের চাপ আসছে, অথচ একজন চালকের নাম পর্যন্ত কেউ লিখে রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। স্থানীয় সাংবাদিকেরা ছবি তুলে না রাখলে সাইফুল, রবিউলের নামগুলো পর্যন্ত আমাদের জানা হতো না।
আমরা ছবিতে দেখেছি, ছেলেগুলো কাঁদছিলেন। অনুনয়-বিনয় করছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলেন রিকশা থেকে ব্যাটারিগুলো খুলে রাখতে। ততক্ষণে পুলিশের আশপাশে ঘুরঘুর করা ষন্ডারা ব্যাটারি খুলে নিয়ে গেছে। কী ভয়ংকর প্রহসন। নিয়মনীতির পরোয়া না করে ভেঙে ফেলা হয় জীবিকার শেষ সম্বল। লুটপাট হয়ে যায় গরিবের ব্যাটারি, রিকশার পার্টস। ব্যাটারিটা সরিয়ে রাখেননি কেন—জিজ্ঞেস করা হলে সাইফুল বলেন, ‘আমার নতুন রিকশা, এত সুন্দর রিকশা, ব্যাটারিটা খুল্যা নিতে খারাপ লাগছিল।’
জানালেন, সাড়ে তিন শ টাকার মিটার লাগানো ছিল রিকশায়। শেষ মুহূর্তে মিটারটা খুলে রাখতে চেয়েছিলেন। অথচ হাত থেকে কেড়ে নিয়ে আছাড় মেরে সেটা ভেঙে ফেলা হয়েছে। সাইফুল আরও বলেন, ‘যেড্যা দিয়া ডলা মারে, ওইডা আসলো। আমার নতুন রিকশাডা ডলে ডলে সমান কর্যা দিল।’
বগুড়ার ঘটনাটা ছোট ঘটনা নয়। এই রাষ্ট্রের নিপীড়নমূলক চেহারাটি মূলত ওই হলুদ বুলডোজারটির মতো। ‘যেটা দিয়ে ডলা মারে’, সেটাই রাষ্ট্র। ভিটা-মাটি, নদী, ফসলের মাঠ, বিল-বাঁওড়-বন, বস্তির ঘর, ফুটপাতের দোকান, ঠেলাগাড়ি-নছিমন-অটোরিকশা, প্রায়শই ডলা দিয়ে দিয়ে পিষে ফেলা হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা, বাহন, খেটে খাওয়ার নিদারুণ প্রচেষ্টা, বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন। সাইফুলের অটোরিকশাটি সেই নির্মম হয়ে ওঠা রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি ছোট্ট কেস স্টাডি মাত্র।