ছেলেটি থাকতো নিলয় নামের একটা বাড়িতে। বুদ্ধি দীপ্ত চোখ, মাথায় কোঁকড়া চুল। নাকটা একটু চাপা,গায়ের রং ফরসা।সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা আবৃতি করতে ভালবাসতো।কবি জসিমউদদীন এর কবর কবিতা আবৃতি করতো।সেই লাইনগুলো যখন বলতো দাদু ধর ধর বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি! যে এই আবৃতি শুনেছে সেই চোখের পানি ফেলেছে।
ছেলেটি স্কুলের বাষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পেত থরে থরে। শিল্ডের আধিক্যে মা বিরক্ত হয়ে যেত।ক্লাসে মেধাবী ছাত্রদের তালিকায় রাবর নাম থাকতো ছেলেটির। আর তাই পুরস্কার ও পেয়েছে। এতো গুনের অধিকারী ছেলেটিকে কৃতী ছাত্রের তালিকায় রেখেছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক স্যার।
পড়ার সময় পড়া আর খেলার সময় খেলা কথাটা দাদী বলতেন। পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তো দুষ্টু ছেলেটি। এনিয়ে কম বকুনি শুনতে হয়নি। মা স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, বাবা খাদ্য মন্ত্রনালয়ের কর্মকতা। দুজনেই ব্যস্ত।শুক্রবার পুরনো পড়া নিয়ে বসতেন আব্বা।কোন রকম গাফিলতি পেলেই শাস্তি বরাদ্দ ছিল। শাস্তির ধরনটা ছিল আলাদা। বই খাতা কেড়ে নেয়া হতো সে সময় মোবাইল ফোন ছিল না।ইন্টারনেট গেইম বা ইউটিউবে সিনেমা /কাটুন দেখার সুযোগ ছিল না। তখন ছিল গল্প বই পড়া,ম্যাগাজিন পড়া বা সেখানে লেখা। আরও ছিল স্ট্যাম্প/কয়েন সংগ্রহ করা,বিভন গাছের পাতা/ফুল সংগ্রহ করে শুকিয়ে খাতায় লাগানো, এবার সেই পাতা বা ফুলের নাম লিখে রাখা।কেউ আবার ময়ুরের পাখা যত্ন করে রাখতো কোরআন শরিফ এর পাতার মাঝে।
বাষিক পরীক্ষা শেষে লম্বা ছুটি হতো,তখন মৌলভি সাহেব বাড়িতে আসতেন আরবী পড়াতে। আরবী পড়ার সময় ছেলেটি বলতোঃ হুজুর আমাকে বাংলা অর্থ বলে দেন। মাঝে মাঝে হুজুর বলতেন, তুই বাংলা অর্থ দিয়ে কী করবি? অর্থ না বুঝে আমি পড়বো না - ছেলেটি মৃদ্যু হেসে উত্তর দিতো।
আমাদের বাড়িতে প্রচলন ছিল জ্বর হলে ভাত খাওয়া বন্ধ। সে সময় পাউরুটি, দুধ,ফল,বাচ্চা মুরগির সুপ মা নিজের তৈরি করে দিতেন। এগুলো খেতে হতো আর বাহিরে যাওয়া একেবারে বন্ধ ছিল।
ভাই-বোন কারো এগুলো খেতে ইচ্ছে হলে বলতাম মা আমার জ্বর হয়েছে। মা কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখার ভান করতেন। আ বলতেন "হু ভিতর ভিতর জ্বর। "
তারপর তাকে সেই বিশেষ খাবার গুলো দেয়া হতো। ছেলেটি একবার খেলতে গিয়ে এক বন্ধুর শার্ট ছিড়ে ফেলে ছিল। বন্ধুর বাবা পরের দিন সেই বন্ধুকে (ফয়জুর) নিয়ে বাসায় নালিশ দেয়। ভর্তুকি বাবদ বন্ধুকে শার্ট কিনে দিতে হয়েছিল বাবাকে । শুনেছি সেই বন্ধুর সাথে অনেকদিন কথা বলেনি সেই ছোট্ট ছেলেটি। ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেল সে বছর ওরা তিন বন্ধু। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়েছিল। ছবিটা বাবার সংগ্রহে ছিল। আর সেই ছোট্ট ছেলেটি বড় হল। বুয়েটে আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিল । আজ বাবা নেই। কি করে হারিয়ে গেল সেই ছেলেটি - তা নিয়ে লিখব অন্য এক সময়। ছেলেটির নাম সৈয়দ জাহীদ হোসেন (জাবেদ)। ৩১আগস্ট ছেলেটির মৃত্যু বাষিকী। সে আমার ভাই।
মারুফা মাজহার একজন লেখিকা ।