শুক্রবার , ২৯ মার্চ ২০২৪

‘নিজেকে অমর করে রাখার সহজ কোনো রাস্তা নেই’

ফিচার ডেস্ক   রবিবার , ০৭ আগষ্ট ২০২২

বহুমাত্রিক লেখক জাকারিয়া জাহাঙ্গীর। বর্তমান সময়কে যারা ধারণ করেন ও হৃদয়ের তুলিতে এঁকে চলেছেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, সাহিত্য সমালোচনাসহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় হস্তচিহ্ন থাকলেও মূলত তিনি একজন কবি এবং কবিই তার মূল পরিচয়।

হাতে শিকলপড়া সময়েও তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্রে সমসাময়িক ও মুক্তচিন্তার বীজ বপন করে চলেছেন নিঃসংকোচে। সেলাই করে চলেছেন প্রেম ও দ্রোহের শব্দ। ৭ আগস্ট (শ্রাবণের বর্ষামুখর) সন্ধ্যায় যমুনা-ঝিনাই বিধৌত জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মদিন উপলক্ষে তার মুখোমুখি হয়েছেন আরেকজন নিভৃতচারী কবি মৃধা আলাউদ্দিন

>> আপনি সাহিত্য চর্চা করেন কেন?
= প্রতিটি মানুষ কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বিশেষত শিক্ষিত মানুষ বলতেই সমাজ তথা রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই দায় শোধ করার তাগিদ অনুভব করলেই ভালো কিছু করার স্পৃহা জাগে। সেই হিসেবে সাহিত্য অনেক বড় একটা মাধ্যম নিজেকে দায়মুক্ত করার। দ্বিতীয়ত আমার একান্ত ভালো লাগা থেকেই সাহিত্য চর্চা করা। যখন নিজের ভালো লাগাগুলো মানুষের ভালো লাগায় পরিণত হবে তখনই পরিপূর্ণ সার্থকতা।

>> আপনার সাহিত্যচর্চার শুরু কবে থেকে?
= আমার সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি অনেকটা শৈশব থেকেই। শূন্য দশকের শুরুতে অর্থাৎ মাধ্যমিক পেরোনোর আগেই আমি ছড়া-কবিতা লিখতে শুরু করি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন বিদ্যালয়ের দেয়াল পত্রিকায় প্রথম একুশের কবিতা প্রকাশিত হয়। ২০০১-০২ সাল বা সমসাময়িক সময়ে দৈনিক ইনকিলাব-ইত্তেফাক পত্রিকার শিশুদের পাতায় ছড়া ছাপা হয়। এরপর থেকে লেখা অব্যাহত আছে।

>> সাহিত্যের প্রতি আপনার এই যে অনুরাগ; অনুপ্রেরণা পেলেন কীভাবে?
= ছোটসময় স্কুল থেকে যখন নতুন বই হাতে পেতাম, বাংলা বইয়ের সবগুলো ছড়া-কবিতা একটানা পড়ে ফেলতাম। তখন ভাবতামÑ এসব মজার মজার ছড়া-কবিতাগুলো যারা লিখেন, তারা না জানি কেমন! ইস্ধসঢ়; যদি আমিও এমন করে লিখতে পারতাম! এই ভাবনা এবং কবিতার প্রতি ভালোবাসা থেকেই নিজে নিজে লেখার চেষ্টা। দ্বিতীয়ত আমাদের বাসায় আব্বা একাধিক পত্রিকা রাখতেন। 

ছোট থেকেই নিয়মিত পেপার পড়ার অভ্যাস ছিলো এবং পত্রিকার ছোটদের পাতার ঠিকানায় ২৫ পয়সার খোলা ডাক এবং ১ টাকার বুকপোস্টে কুইজ বা ধাঁধার উত্তর, শব্দজট, কৌতুক, ছড়া ইত্যাদি পাঠানো শুরু করি। প্রথম দিকে ক্লাসের বন্ধুরা আমার এসব কাজ দেখে হাসিঠাট্টা করলেও প্রথম যখন পত্রিকার পাতায় আমার নাম ছাপা হয় তখন সবাই অবাক হয়ে যায়। আমার মনে পড়ে, কয়েকদিন পত্রিকায় নাম ছাপার পর আব্বা খুশি হয়ে ৫ টাকা দিয়ে আমাকে একটা কোর্ট ফাইল কিনে দিয়েছিলেন পত্রিকার পাতাগুলো সংরক্ষণে রাখার জন্য।

>> আপনার প্রকাশিত বই সম্পর্কে বলুন।
= ২০১৩ সালে আমার প্রথম একটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরপর আরো দুটি যৌথ কাব্যগ্রন্থ বের হলেও প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ ‘মেহেদি পাতার রঙ’ প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের অমর একুশে বইমেলায়। এরপর ভুল পাওয়ারের চশমা (২০১৯) ও অস্পর্শ চাঁদ (২০২০) নামে আরো দুটি কাব্যগ্রন্থ বের হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালে প্রথম প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বাইরে ভাইরাস ভেতরে ক্ষুধা’ প্রকাশিত হয়। পেশাগতভাবে সাংবাদিকতায় জড়িত থাকায় নিজের চোখে রাজনীতি ও সমাজের নানা অবক্ষয় যা দেখছি তার কিছুটা এ বইতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কাব্যগ্রন্থগুলোতে প্রেম, বিরহ ছাড়াও রাজনীতি ও সামাজিক নানা অসঙ্গতিবিষয়ক কবিতা স্থান পেয়েছে।

>> প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি কেমন ছিল?
= প্রথম প্রকাশ বা প্রথম বই প্রথম সন্তানের মতো। এর অনুভূতি কারো ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, জীবনের শ্রেষ্ঠ উপভোগ্য বিষয়। তবে একটি কথা সত্য, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মেহেদি পাতার রঙ’-এ শৈশব-কৈশোরে কাঁচা হাতে লেখা কিছু আনাড়ি কবিতাও স্থান দিয়েছি। কেননা, প্রথম সৃষ্টিকে অস্বীকার করা যায় না, এটা কারো উচিতও নয়। প্রথম সন্তান কালা, বোঁচা, বেটে হলেও সন্তান।

>> প্রেম এবং রাজনীতি পরস্পরবিরোধী, উভয়ই আপনার লেখায় সমানভাবে ফুটে উঠেছে, এটা কীভাবে সম্ভব?
= প্রেম, কামকলা, বিরহ, সাহিত্যের অন্যতম প্রধান উপজীব্য বিষয়। আর এ ৩টির সাথে নারী ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নারী ও প্রেম ব্যতীত সাহিত্য কল্পনাও করা যায় না। এটা যেমন ঠিক, তেমনি বর্তমানে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সাদাকে সাদা ও কালোকে কালো বলার মানুষের বড্ড অভাব। সেই হিসেবে অধিকাংশের কাছেই সাহিত্যের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা প্রেম, কাম, বিরহ নিয়ে পড়ে থাকা। কিন্তু সমাজের কাছে একজন লেখকের যে দায়বদ্ধতা আছে, তা অস্বীকার করার উপায় আছে কি? আমার ভাবনাটা তাই এমনই, প্রেম ও প্রতিবাদ উভয়ই যেন লেখায় থাকে এবং মানুষকে উজ্জীবিত করে।

>> শৈশবের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।
= যমুনা-ঝিনাই নদীবিধৌত এলাকায় আমার জন্ম। শৈশবের বেশিরভাগ সময় কাটতো নানা বাড়ি চরাঞ্চলে। সেই সুবাদে শৈশবের সব স্মৃতিই মধুর। নদীতে গোসল করা, চরাঞ্চলের সরিষা, বেগুন, মরিচ ক্ষেতের ঘ্রাণ এবং আইল ধরে হাঁটার স্মৃতি এখনো বিমোহিত করে। শৈশবে ঈদে মাত্র দু-তিনশ টাকায় কেনা নতুন পাঞ্জাবির যে ঘ্রাণ পেতাম, এখন দু-তিন হাজার টাকা দামের কাপড় কিনলেও সেই ঘ্রাণ আর পাই না। আরেকটা বিষয় হলো, এ যুগের বাচ্চাদের তো স্কুল ফাঁকি দেয়ার উপায় নেই। কিন্তু আমরা যারা নব্বই দশকের ছেলেমেয়ে তাদের অনেকের ঝুলিতে স্কুল পালানো নিত্যকার ঘটনা। আমি প্রাইমারিতে অনেক ফাঁকিবাজ ছিলাম, মেধাবীও ছিলাম। দু-তিনটি স্কুল পাল্টিয়ে ৫ম শ্রেণিতে যখন বৃত্তি পাই, তখন আগের স্যাররা অবাক এবং অনেক খুশি হন।

>> সাহিত্যে আপনার পুরস্কারপ্রাপ্তি সম্পর্কে জানতে চাই।
= সাহিত্য হচ্ছে সাধনা। এটার জন্য কোনোকিছু প্রাপ্তির আশা করা মানেই স্বার্থ। স্বার্থ চিনলে সাহিত্য হয় না, খ্যাতি আসতে পারে। নিজেকে অমর করে রাখার সহজ কোনো রাস্তা নেই, খ্যাতির জন্য একজীবন সাধনা করতে হয়। আপনি যা করে গেলেন, তার মর্যাদা হয়তো জীবদ্দশায় নাও পেতে পারেন, কিন্তু সৃষ্টিকর্ম যদি কালজয়ী হয় মৃত্যুর পর হলেও মানুষ আপনাকে চিনবে। তাই আমি কখনো নিজের পুরস্কারের বিষয়ে ভাবি না; আর এমন কোনো মানুষও হয়ে উঠিনি। 

তবে ছোটখাটো কিছু অর্জন আছে, যা আমার কাজের চেয়ে প্রাপ্তিই বেশি মনে করি। ২০১৩ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর কর্তৃক যুববিষয়ক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় দেশ সেরা প্রাবন্ধিকের পুরস্কার পাই। এছাড়াও বিদ্যাপীঠ সাহিত্য পদক, দৈনিক বাঙ্গালীর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার, শীর্ষবিন্দু সাহিত্য পুরস্কার, বঙ্গভূমি সাহিত্য পদক, শাহ্ধসঢ়; আয়েজ উদ্দিন চিশতি সম্মাননা, বাংলাদেশ কবিসভা গুণীজন সম্মাননাসহ বেশ কয়েকটি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করি।

>> শিল্প-সাহিত্য নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?
= জীবনে ভালো কিছু লিখতে চাই। অন্তত একটি কবিতা কিংবা এমন একটি লাইন হলেও লিখতে চাই, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে উজ্জীবিত করবে এবং আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।

 সাহিত্যাঙ্গন থেকে আরোও সংবাদ

ই-দেশকাল

আর্কাইভ