অনুবাদ : সাজিদ উল হক আবির
[হারুকি মুরাকামির ইংরেজিতে অনূদিত গল্পগ্রন্থ মেন উইদাউট ওমেন-এর 'পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউজ ইউকে' সংস্করণে ফিলিপ গ্যাব্রিয়েলকৃত ইংরেজি অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ এটি।]
ফোনকলটা এসেছিল রাত ১টার পর। ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগিয়ে তুলেছিল আমাকে। মাঝরাতের ফোনের রিঙের মতো কর্কশ এবং বিরক্তিকর আর কিছু হয় না, মনে হয় যেন ধাতব এক যন্ত্র নিয়ে কেউ বেরিয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়া ভেঙে চৌচির করে দেওয়ার উদ্দেশে।
ফলে ও আওয়াজ কানে এসে আঘাত করামাত্রই আমার মনে হলো যে এই মাঝরাত্তিরে সমগ্র মানবজাতিকে আশু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার দায়িত্ব আমার কাঁধে এসে ন্যস্ত হয়েছে, এবং আমি কোনোক্রমে বিছানা ছেড়ে উঠে লিভিং রুম পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে এনে কানে ঠেকালাম।
একটি পুরুষের ফিসফিসে কণ্ঠ রিসিভারের ওপাশ থেকে আমাকে জানাল যে, পৃথিবী থেকে একজন নারী মুছে গিয়েছে চিরতরে। কণ্ঠটি ছিল সেই নারীর স্বামীর। অন্তত ফোনের ওপাশ থেকে তাই ছিল তার দাবি। এবং সেসূত্রে সে আলাপ চালিয়ে গেল। গত বুধবার আমার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে, বলল সে। যা হোক, আমার মনে হলো যে আমার আপনাকে জানানো দরকার। যা হোক।
ফোনে শুনে যা বুঝলাম, পুরো ঘটনাটা সে বর্ণনা করল কণ্ঠে আবেগের লেশমাত্র উপস্থিতি ছাড়া। মনে হচ্ছিল, সে একটা টেলিগ্রাম পড়ে শোনাচ্ছে আমাকে, তাও এমন এক টেলিগ্রাম যার শব্দগুলোর মাঝে কোনো ফাঁকা স্থান নেই। যেন এক সহজ, সাধারণ ঘোষণাপত্র পড়ে শোনাচ্ছে সে। কোনোরকম অলঙ্করণ ছাড়া শুকনো বাস্তবতা। ব্যস, দাড়ি।
উত্তরে আমি কি বলেছিলাম? কিছু একটা নিশ্চয়ই বলেছিলাম, যা এখন আর মনে করতে পারছি না। মনে পড়ে যে আমাদের আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে ছিল বিশাল বিশাল নীরবতা। যেন বিশাল গর্ত বা খানাখন্দওয়ালা এক রাস্তায়, গর্তের দুপাশে দাঁড়িয়ে আমরা দুজন একে অপরের দিকে চেয়ে আছি।
খানিকক্ষণ পর, বিদায় সম্ভাষণের জন্য কোনো শব্দ ব্যয় করা ছাড়াই, যেন এক ভঙ্গুর শিল্পকর্ম অতি যত্নের সাথে মেঝেতে নামিয়ে রাখার মতো করে সে ফোনের রিসিভার রেখে দিলো অপর প্রান্তে। এদিকে আমি সাদা টিশার্ট আর নীল রঙের জাঙ্গিয়া পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম ফোনের রিসিভার হাতে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে।
সে আমার সম্বন্ধে জানল কীভাবে? আমার কোনো ধারণা নেই। তার মৃত স্ত্রী কি এই ভদ্রলোক, তথা তার স্বামীকে বলেছিল আমার কথা? পরিচয় দিয়েছিল আমার, তার প্রাক্তন প্রেমিক হিসেবে? কেন? আর এই লোক আমার ফোন নম্বরই-বা জানল কীভাবে? (কোন টেলিফোন ডিরেক্টরিতে আমার নাম নেই) সবচে বড় কথা হলো, আমাকেই কেন? কেন একজন মানুষ মাঝরাতে ফোন করার হ্যাপা মাথায় নিয়ে আমাকে তার স্ত্রীর মৃত্যু-সংবাদ দেবে?
মনে তো হয় না যেকোনো মহিলা মৃত্যুর আগে তার শেষইচ্ছা হিসেবে চিরকুটে তার স্বামীর উদ্দেশে এমন এক অনুরোধ লিখে রেখে যাবে। বহু বছর আগে সে নারীর সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। তারপর আমাদের আর কখনোই দেখা হয়নি, একবারের জন্যও না। এমনকি ফোনেও তারপর আর আলাপ হয়নি আমাদের।
এসপার বা ওসপার, কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছানো যাচ্ছিল না। আরও বড় গ্যাঞ্জাম হলো, সে আমাকে ফোনে কিছুই ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি। তার কেবল মনে হয়েছে যে, তার স্ত্রীর আত্মহত্যার সংবাদটা আমার পর্যন্ত পৌঁছানো প্রয়োজন। এবং কোনোভাবে সে আমার ফোন নম্বরটা পেয়ে গিয়েছে বলে সে দায়িত্ব সমাধা করেছে।
এছাড়া আর কিছুই না। সবকিছু বিবেচনায় মনে হয় যে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাকে জ্ঞান আর অজ্ঞানতার মধ্যবর্তী স্থানে এক দোদুল্যমান অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু কেন? সে হয়তো আমাকে ভাবিয়ে তুলতে চায় কিছু একটা বিষয়ে। কি সেটা? চিন্তা করে কোনো লাভ হচ্ছিল না। শিশুরা যেমন হাতের কাছে মুফতের রাবার স্ট্যাম্প আর খালি খাতা পেয়ে গেলে সে খাতার ওপরে ক্রমাগত সিল মেরে চলে, ঠিক সেই অনুপাতে মনের মধ্যে আমার প্রশ্ন জমা হচ্ছিল একের পর এক।
ফলে এখনো আমি জানি না যে, কেন অথবা কীভাবে তার স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে। এমনকি আমার যদি আগ্রহ থেকেও থাকে, আমার পক্ষে জানবার কোনো উপায় নেই। সে কোথায় থাকে, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই, এমনকি সে যে বিয়ে করেছিল, এ কথাও আমি জানতাম না মোটেই। বিয়ের পর সে কি নাম বদলে তার স্বামীর পদবি গ্রহণ করেছিল? (ফোনে লোকটা ওর পুরো নাম মুখে উচ্চারণ করেনি বলে নিশ্চিত নই) কতদিন ধরে বিবাহিত ছিল তারা? সন্তান ছিল কি তাদের, এক বা একাধিক?
এত এত প্রশ্ন মনের মাঝে উত্থাপিত হবার পরেও আমি সেই নারীর স্বামীর ভাষ্য মেনে নিলাম। আমার ইচ্ছে হলো না সন্দেহ করতে। আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হবার পরেও সে রমণী বেঁচেছিল এই পৃথিবীতে, সম্ভবত প্রেমে পড়েছিল অন্য কোনো পুরুষের, বিয়ে করেছিলে তাকে, তারপর, গত বুধবার, যেকোনো কারনে, যেকোনো উপায়ে সে তার জীবনের ইতি টেনেছে।
সে যাই হোক। ফোনের ওপারে থাকা লোকটির কণ্ঠে এমন কিছু ছিল, যাতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল যে সে তার স্ত্রীর মৃত্যুর মধ্যদিয়ে ইতোমধ্যে মৃতদের পৃথিবীর সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে। মধ্যরাতের নীরবতায়, তার কণ্ঠের টানটান স্থিতিস্থাপকতার মধ্যদিয়ে সেই সংযোগ আমি টের পাচ্ছিলাম। কাজেই পরিকল্পনা মাফিক হোক, বা হুট করেই হোক, আমাকে রাত ১টার পর ফোন করে এই তথ্যটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত তার তরফ থেকে সঠিক ছিল।
রাত ১টার বদলে দুপুর ১টায় ফোন করে আমাকে এই সংবাদটি দিলে আমি তার কণ্ঠের আড়ালে সুপ্ত পরিভাষার সঠিক মর্ম নিরূপণ করতে পারতাম না। রিসিভার জায়গামতো ঝুলিয়ে বিছানায় ফিরে আসতে আসতে আমার স্ত্রী সজাগ হয়ে গিয়েছিল। ‘কে কল করেছিল এত রাতে? কোন দুঃসংবাদ? কেউ মারা গিয়েছে?’ সে জিজ্ঞেস করল। কেউ মারা যায়নি। রংনাম্বার।’ মৃদুস্বরে, ঘুমজড়ানো কণ্ঠে আমি উত্তর করলাম।
মনে হয় না যে আমার স্ত্রী আমার কথা বিশ্বাস করল, কারণ ততক্ষণে মৃতদের পৃথিবীর সঙ্গে আমার কণ্ঠেরও কোনোভাবে একটা সংযোগ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাজা তাজা মৃত্যুর খবরের সঙ্গে অস্থিরতা পরিবাহিত হয়ে আসে, তা খুব সংক্রামক।
দূরালাপনির তারের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত সে কম্পমান শব্দতরঙ্গ বহিঃপৃথিবীকে তার কম্পাঙ্কের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে নির্দ্বিধায়। সৌভাগ্যক্রমে আমার স্ত্রী আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইল না। আমরা দুজনেই শুয়ে রইলাম অন্ধকারে, আমাদের কর্ণকুহর নিশুতি রাতের নীরবতার প্রতি প্রবলভাবে সজাগ অবস্থায়, যে যার চিন্তার জগতে নিমজ্জিত হয়ে।
এই নিয়ে তিনজন নারী আত্মহত্যা করল, যাদের সঙ্গে একদা আমার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। চিন্তা করলে বোঝা যায় (অথবা চিন্তা না করলেও এমনি এমনিই এ সমঝদারি চলে আসে যে) এটা খুব উচ্চসংখ্যক মৃত্যুর হার। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না।
জীবনে খুব বেশি সংখ্যক নারীর সঙ্গে আমার প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল না। কেন এই তরুণীরা, এত কম বয়সে জীবনের ইতি টানছিল, বা টানতে বাধ্য হচ্ছিল—আমার কাছে তার কোনো ব্যাখ্যা ছিল না। আশা করি আমি কোনোভাবে তাদের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সরাসরি, বা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সংযুক্ত নই।
এবং আমি আশা করি, তারা হয়তো আমাকে তাদের মৃত্যুর প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে মনে মনে কামনাও করেনি। এই ছিল আমার একান্ত আশা। এবং — আসলে কীভাবে গুছিয়ে বলব ব্যাপারটা— এই মেয়েটা, এই তৃতীয় মেয়েটা (কোনো নামে তাকে না ডাকাটা উদ্ভট শোনাবে, কাজেই ধরা যাক তার নাম ছিল ‘ম’)—আত্মহত্যা করার মতো মেয়ে ছিল না একদমই।
বরং ছিল তার একদম উল্টো। সবসময়ই তাকে ঘিরে থাকত তার প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা আকর্ষণীয় পেশিবহুল শরীরের প্রেমিকেরা। তৈরি থাকত তাকে প্রতিমুহূর্তে যেকোনো বিপদ থেকে উদ্ধার করার জন্য।
'ম' এর সঙ্গে আমার পরিচয় কীভাবে হয়েছিল, মেয়ে হিসেবে সে কেমন ছিল, বা ডেট করবার সময় একসঙ্গে আমরা কি কি করতাম এ নিয়ে কোনো আলাপে যেতে আপাতত আমি অপারগ। এসমস্ত তথ্য একবার ফাঁস হয়ে গেলে তা আমাদের আশপাশের জীবিত মানুষজনের জন্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা বয়ে আনবে। কাজেই এতটুকু বলাই আপাতত শ্রেয় যে, একসময় আমরা একসঙ্গে ছিলাম, এবং পরবর্তীতে আমাদের দুজনের পথ আলাদা হয়ে গেছে।
খুব সম্ভব ওর বয়স চৌদ্দ ছিল, যখন ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়। তথ্য হিসেবে এটা সত্য নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ইচ্ছে করছে এরকমটা ভাবতে। আমরা দুজনেই যখন চৌদ্দ, তখন এক জুনিয়র হাইস্কুলের শ্রেণিকক্ষে দেখা হয়েছিল আমাদের। জীববিজ্ঞান ক্লাস ছিল সেটা—যদ্দুর মনে পড়ে। ও আমার পাশের সিটে বসেছিল। ‘আমি আমার ইরেজারটা আনতে ভুলে গেছি,’ ওকে বলেছিলাম আমি।
‘কাজেই তোমার যদি অতিরিক্ত একটা ইরেজার থেকে থাকে, আমাকে তা ব্যবহার করতে দেবে খানিকক্ষণের জন্য?’ আমার প্রশ্নের উত্তরে ও নিজের ইরেজারটা বের করে মাঝ বরাবর ভেঙে দুটুকরো করে অর্ধেকটা নিজের কাছে রেখা বাকি অর্ধেক আমাকে দিয়ে দিলো সম্পূর্ণ। বইপত্রে লেখকরা রোমান্সের বর্ণনা যেভাবে দেয়, ঠিক সেভাবেই, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমি ওর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সে ছিল আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে। অন্তত তখন আমার অনুভূতি তাই ছিল।
এভাবেই আমি ওকে স্মরণ করতে ভালোবাসি, এভাবেই স্মরণ করতে চাই আমাদের প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি, এক জুনিয়র হাইস্কুলের ক্লাসরুমে। পরস্পর বিপরীত বৈশিষ্ট্য সম্বলিত প্রকৃতির দুই সন্তানের মধ্যে সহজাত আকর্ষণের সূত্র ধরেই আমরা আকৃষ্ট হয়েছিলাম একে অপরের প্রতি। এভাবে ঘটনাপ্রবাহ কল্পনা করলে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো সহজ হয়।
আমি ছিলাম স্বাস্থ্যবান চৌদ্দ বছর বয়েসি এক ছেলে। যৌবনের তাড়নায় এতোটাই উন্মূখ যে, পশ্চিম দিক থেকে ধেয়ে আসা একঝলক উষ্ণ বাতাসের তোড়েই আমার পুরুষাঙ্গ উত্থিত হয়ে যেত লোহার মতো শক্ত হয়ে। বয়সটাই তখন এমন ছিল আমার। তবে তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই যে আমার পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে গিয়েছিল, এমন ছিল না ব্যাপারটা। বরং সে যেন কীভাবে আমার আর পশ্চিমা বাতাসের মাঝখানে দেওয়াল তুলে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
শুধু তাই না, সে ছিল এতোটা অনন্যসাধারণ যে, তাকে দেখামাত্রই যেন আমার চারপাশে বাতাসের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যেত। এরকম ঐশ্বরিক আভা ঠিকরে বেরোনো চেহারার একটা মেয়েকে দেখে আমার ক্ষুদ্র জৈবিক তাড়না জেগে উঠতই-বা কীভাবে? এরকম সম্পূর্ণ অচেনা এক অনুভূতির সঙ্গে প্রথমবারের মতো পরিচয় করিয়ে দেওয়া নারী ছিল এই 'ম'।
যা হোক, এ কিন্তু কেবল মনে মনে ধরে নেওয়া যে, এভাবে আমার সঙ্গে 'ম' এর পরিচয় হয়েছিল। আসলে আমাদের পরিচয় ঘটেনি ওভাবে, কিন্তু যা বললাম—এভাবে ব্যাপারগুলো চিন্তা করলে সবকিছু সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়। আমি চৌদ্দ, সেও চৌদ্দ। একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হবার এটাই ছিল সবচেয়ে নিখুঁত বয়স। এভাবে আমাদের পরিচয় ঘটলেই সেটা হতো সবচেয়ে মানানসই। কিন্তু আমাকে বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত না দিয়ে 'ম' উধাও হয়ে গিয়েছিল আমার জীবন থেকে।
কোথায়, আমার কোনো ধারণা নেই। একদিন হঠাৎ করে দেখি, ওকে আর খুঁজে পাচ্ছি না কোথাও। যেন পাশাপাশিই বসেছিলাম আমরা, আমি তাকিয়েছিলাম কোনো একদিকে, ভাবছিলাম কিছু একটা, হঠাৎ পাশ ফিরে দেখি ও আর নেই। আগের মুহূর্তেই ছিল হয়তো, হঠাৎ যেন মিশে গেছে বাতাসের সঙ্গে। হয়তো কোনো পাথরে খোদাই করা পেশিবহুল শরীরের নাবিকের ডাকে সে জাহাজে করে ভেসে পড়েছিল মার্সেই, বা আইভরি কোস্টের দিকে। তাকে হারানোর ফলে সৃষ্ট আমার যে হতাশার গভীরতা ছিল পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্রপথের চেয়েও অনতিক্রম্য।
দানবাকৃতির স্কুইড, কিংবা সামুদ্রিক ড্রাগনরা সাঁতরে বেড়ায়—এমন ভয়াল গভীর যেকোনো সমুদ্র থেকেও গভীরতর ছিল আমার বুকের মাঝে আশাভঙ্গের বেদনাজনিত গভীরতা। আমি নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিলাম। বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম আশপাশের সবকিছু থেকে। ঘটল কীভাবে এটা কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলাম না। এই ছিল 'ম' এর প্রতি আমার ভালোবাসা, এই হচ্ছে 'ম' আমার জীবনে কি অর্থ বহন করত—তার বয়ান। এতোটা গভীরভাবেই ওকে চাইতাম আমি। আহা, কেন যে হারিয়েছিলাম ওকে আমি?
উল্টোভাবে, তখন থেকেই আমি 'ম' কে সবখানে দেখা শুরু করি। যেখানেই যাই, ওর উপস্থিতি টের পাই আমার সঙ্গে। এভাবে সে অংশী হয়ে যায় আমার পরিচিত অনেক জায়গা, অনেক সময়, অনেক মানুষের। ওর ভেঙে দেওয়া ইরেজারের আধখানা আমার সঙ্গে একটা প্ল্যাস্টিকের ব্যাগে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, কোনো এক শুভচিহ্ন মতো, অথবা এক কম্পাসের মতো।
যতক্ষণ তা আমার পকেটে থাকে, আমার মনে হয় কোনো দিন, কোনখানে হয়তো আমাদের আবারো দেখা হয়ে যাবে। আমি নিশ্চিত ছিলাম 'ম'কে আবারো খুঁজে পাব আমি। নিশ্চয়ই কোনো বাকপটু জাহাজি মিষ্টি মিষ্টি কথায়, নতুন—অদেখা দেশভ্রমণের নাম করে ওকে জাহাজে তুলে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে বহুদূরে। ও এমনি এক মেয়ে ছিল, যে সবাইকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে। এমন এক মেয়ে ছিল ও, যে নির্দ্বিধায় নতুন কেনা একখানা ইরেজার ভেঙে দুটুকরো করে অপরিচিত এক ছেলেকে তার আধখানা দিয়ে দেয়।
আমি সম্ভাব্য সকল মানুষ, এবং সকল জায়গা থেকে ওর ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার সবই ছিল ছেঁড়াফাঁটা, টুকরাটাকরা খবর। আর টুকরো খবরকে যতই জোড়া লাগানোর চেষ্টা করুন, দিনশেষে তা টুকরো খবরই থেকে যায়। তাই 'ম'-এর সত্তার সুবাস দূর মরীচিকার মতোই মিলিয়ে যেত সবসময়। যে দিগন্তে গিয়ে ও মিলিয়ে যেত, ভূপৃষ্ঠ থেকে তার দূরত্ব ছিল অসীম। যেমন করে সমুদ্র আর আকাশ দূরপ্রান্তে গিয়ে একসঙ্গে মিলেমিশে যায়। তবুও আমি ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে চলেছি তার পিছে, বোম্বে থেকে কেপটাউন, সেখান থেকে রেকজাভিক, তারপর বাহামা। বন্দরনগরী বিশিষ্ট পৃথিবীর সবকটা শহর আমি ঢুঁড়ে ফিরেছি, কিন্তু কখনো খুঁজে পাইনি ওকে।
ওকে খুঁজতে খুঁজতে একটা বন্দরে এসে আমি পৌঁছার কিছুক্ষণ আগেই হয়তো সে তার নতুন যাত্রা শুরু করে দিয়েছিল নতুন কোনো বন্দরের উদ্দেশে। ওর একদা উপস্থিতির উষ্ণতা লেগে থাকত হয়তো কোনো হোটেল রুমের কামরার খাটে, ওর ফেলে যাওয়া এক স্কার্ফ হয়তো ঘূর্ণায়মান ঝরনাধারার মতো করে ঝুলে থাকত কোনো চেয়ারের পিছে। ওর উপস্থিতির চিহ্ন পাওয়া যেত পৃষ্ঠা খুলে টেবিলের ওপর ফেলে রাখা কোনো আধপড়া বইয়ের পাতায়। বাথরুমের রিলে ঝুলিয়ে রাখা আধশুকনো কোনো লম্বা মুজো। কিন্তু ওকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। দুনিয়ার তাবৎ চতুর নাবিকেরা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে আগেভাগেই ওকে নিয়ে হারিয়ে যেত অন্য কোথাও, দূর কোনো বন্দরে। এই করতে করতে চৌদ্দ পেরিয়ে আমারও বয়স বাড়তে লাগল।
আমার গায়ের রং রোদের তাপে আরও ঝামাঘসা হয়ে গেল, আমি আরও রুক্ষ হয়ে উঠলাম। আমার দাঁড়ি আরও ঘন হয়ে উঠল, এবং আমি নির্ভুলভাবে সাহিত্যের পাতায় মেটাফর আর সিমিলির পার্থক্য নিরূপণ করতে সক্ষম হলাম। কিন্তু আমার অস্তিত্বের একটা নিগূঢ় অংশ তখনও চৌদ্দতেই আটকা পড়ে রইল। এবং আমার মনের চৌদ্দতে আটকা পড়া সে অংশ খুব ধৈর্যের সঙ্গে আমার নিষ্পাপ যৌনাঙ্গের ওপর অতীতকালে বয়ে যাওয়া সেই শান্ত সমাহিত পশ্চিমা বাতাসের প্রবহমানতার অপেক্ষায় রইল। পৃথিবীর যে প্রান্তে সেই উষ্ণ পশ্চিমা বাতাস বইবে, সেখানেই 'ম' এর সঙ্গে আবার দেখা হবে আমার। এই ছিল 'ম' এর পরিচয় আমার কাছে। সে ছিল এমন এক নারী, যার এক জায়গায় থিতু হবার অভ্যাস ছিল না কখনো।
কিন্তু সেই নারী ছিল না সে, যে নিজ হাতে নিজের প্রাণ ছিনিয়ে নেবে। আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই যে এতক্ষণ ধরে কি আবোলতাবোল বকছি। হয়তো আমার বর্ণনায় কোনো নৈর্ব্যক্তিক সত্য নেই, হয়তো আমার চোখে ও যেমন ছিল সেটাই বর্ণনা করে চলেছি বিক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু এও তো অনস্বীকার্য যে, কারো ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে নৈর্ব্যক্তিকতা এড়িয়ে আলাপ করাটা অনেকটা, ঐ যে বলে না, ‘অন দা ডার্ক সাইড অফ মুন’, ওরকম, চাঁদের অন্ধকার দিকটাতে বসে গুলতাপ্পি মারার মতোন।
পুরো প্রেক্ষাপটই যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন, এবং ক্রমাগত একটা বিষয় থেকে আরেকটা বিষয়ে অগ্রসর হতে থাকা, কোনো সমাপ্তি চিহ্নের উপস্থিতি ছাড়া। বিষয়বস্তুর বিশালতার নিরিখে, এ আলাপ কখনো সমাপ্তির মুখ দেখে না। তো যাই হোক, যেটা বলতে চাইছি তা হলো—'ম' হচ্ছে সেই নারী, যার ওপর চৌদ্দ বছর বয়সেই আমার প্রেমে পড়া উচিত ছিল। আমি প্রেমে পড়েছি, দুঃখজনকভাবে আরও অনেক পরে। কিন্তু তখন তার বয়স আর চৌদ্দ ছিল না।
আমরা ভুল সময়ে পরিচিত হয়েছিলাম একে অপরের সঙ্গে। কখনো কখনো টাইম শিডিউল মাথায় না রেখে কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায় না আমাদের, ওরকম ছিল ব্যাপারটা। জায়গা ঠিক, সময় ঠিক, কিন্তু দিনটা হয়তো ভুল হয়ে গেল, অমন। চৌদ্দ বছর বয়সী একটা মেয়ে তার ভেতর বেঁচে ছিল তবুও। এবং তার সে চৌদ্দ বছরের সত্তাটি ছিল পরিপূর্ণ, কোনো ভগ্নাংশ নয়। ভালো করে লক্ষ করলে হয়তো সেই চৌদ্দ বছরের বালিকা সত্তার 'ম' এর ভেতরে প্রবেশ আর বেরিয়ে আসা দেখতে পেতাম আমি।
ভালোবাসাবাসির চরমতম মুহূর্তে ও যখন আমার বাহুডোরে আবদ্ধ, তখন আমি লক্ষ করতাম যে এক মুহূর্তে ওর মুখাবয়ব একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মতো লাগছে তো ঠিক তার পরবর্তী মুহূর্তে ও পরিণত হয়েছে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর চপল এক কিশোরীতে। সে নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সময়ের সীমারেখায় ঘুরে ফিরে বেড়াত সবসময়। এবং আমি ভালোবাসতাম ওর এ ব্যাপারটাকে। সঙ্গমের মুহূর্তে ওকে জড়িয়ে ধরতাম আমি, এতো জোরে যে — ও বলত ওর ব্যথা লাগছে। হয়তো আসলেই ওকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরতাম আমি, কিন্তু আমার কিছু করার ছিল না। আমি ওকে সে মুহূর্তে হারাতে চাইতাম না।
সে যাই হোক, তারপর তো এমন একটা সময় এলোই, যখন ওকে আমি হারিয়ে ফেললাম। পৃথিবীর সমস্ত নাবিকের লোভাতুর দৃষ্টি ওর ওপর আবদ্ধ ছিল যেহেতু। আমার একার পক্ষে ওকে ধরে রাখা সম্ভব ছিল না। পৃথিবীতে কেউ কারো ওপর প্রতিটা মুহূর্ত নজরদারি করতে পারে না। একজন মানুষের ঘুমানো লাগে, বাথরুমে যাওয়া লাগে। কখনো কখনো বাথটাবও ঘষামাজা করা লাগে। পেঁয়াজ কাটা লাগে, সবজি ছেঁলা বাছাকোটা লাগে।
গাড়ির চাকার হাওয়া পরীক্ষা করা লাগে। দৈনন্দিন জীবনের এসব পাঁচালিতে ব্যস্ত থাকতে থাকতেই একদিন আবিষ্কার করলাম যে আমরা আলাদা হয়ে গেছি। অথবা, সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমাদের সম্পর্কের পেছনে ছায়া হয়ে সবসময়ই কোনো এক নাবিকের উপস্থিতি টের পাওয়া যেত। একটা বিশাল একক ছায়া, যা উত্থিত হওয়ামাত্র ঢেকে ফেলত সুবিশাল দালানকোঠাকেও। বাথটাব, পেঁয়াজ কাটা, গাড়ির টায়ারে বাতাস পরীক্ষা করা সংক্রান্ত ব্যস্ততার কথা যে বললাম — ওগুলো তো স্রেফ মেটাফরিক্যালি, কাজের বিভিন্ন শ্রেণিকরণ হিসেবে উল্লেখ করলাম। বলার জন্যেই বলা।
ও চলে যাওয়ার পর পৃথিবীর কেউই টের পায়নি যে ভেতরে ভেতরে কি অসহায় বোধ করতাম আমি, কি ভাংচুরের ভেতর দিয়ে যাওয়া লেগেছে আমার। কেউ বুঝবেই-বা কীভাবে? আমার নিজেরই এখন তা খুব সামান্য পরিমানে স্মরণ আছে। কতোটুকু ভুগতে হয়েছে আমার? কতোটুকু কষ্টের মধ্যদিয়ে যাওয়া লেগেছে? খুশি হতাম যদি মানুষের দুঃখ পরিমাপক একটা যন্ত্র পৃথিবীতে আবিষ্কৃত হতো, যদি তা ঠিকঠাক মতন একদম নিখুঁত সংখ্যায় আমাদের দুঃখ পরিমাপ করে দিতে পারত। আরও ভালো হতো যদি সে যন্ত্র আমাদের হাতের মুঠোয় পোরা সম্ভব, এমন আকারের হতো। প্রতিবার আমার গাড়ির চাকার হাওয়া পরীক্ষা করার মুহূর্তে এ কথা একবার করে মনে হয় আমার।
শেষমেশ সে মারা গেল। মাঝরাতের ফোনকলে আমাকে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি জানি না কোথায়, কীভাবে, কেন, বা কোন যুক্তিতে 'ম' আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, কিন্তু সিদ্ধান্তটা সে নিয়েছিল, এবং পূর্ণ করেছিল। এভাবে, খুব নীরবে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল ও। পৃথিবীর কোন নাবিকের সুমিষ্ট বচন তাকে আর মৃতদের রাজ্য থেকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু মাঝরাতে যদি এখনও খুব নিবিষ্ট চিত্তে আপনি বাতাসে কান পেতে রাখেন, হয়তো শুনতে পাবেন দূর থেকে ভেসে আসা 'ম' এর জন্যে কোন নাবিকের বিষাদগ্রস্ত কণ্ঠে গাওয়া মর্সিয়ার ধ্বনি।
ওর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আমার চৌদ্দ বছরের সত্তাটিরও মৃত্যু হয়। কোনো বেইসবল ক্লাবের কিংবদন্তি এক খেলোয়াড় অবসরে গেলে তার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের নিদর্শনস্বরূপ তার জার্সি নম্বরটাকেও যেমন তুলে নেয়া হয় চূড়ান্তভাবে, ঠিক একইভাবে, নিভৃতে চৌদ্দ বছর বয়স আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে গেছে। আমার সে বয়স এখন নিখুঁত, নিটোল, ও কঠোরভাবে আটকা পড়ে আছে ভূপৃষ্ঠের মাইলকে মাইল নিচে, কোনো সমুদ্রের গহিন অতলে। যে সিন্দুকের ভেতরে সে আটকা পড়েছে, তা আর খুলবে না আগামী লাখ লাখ বছরেও। গভীর সামুদ্রিক প্রাণীদের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে বন্দি থাকবে সে। স্নিগ্ধ পশ্চিমা বাতাস আর প্রবাহিত হয় না। সারা দুনিয়ার সমস্ত নাবিকেরা 'ম' র শোকে মাতম করে বেড়াচ্ছে। এবং নাবিক-বিরোধীরাও, বলা বাহুল্য।
'ম'-এর মৃত্যুর খবর জানবার পরপরই আমি নিশ্চিতভাবে অনুভব করলাম, জগতের 'নিঃসঙ্গতম' মানুষ না হলেও, আমি জগতের 'দ্বিতীয় নিঃসঙ্গতম' মানুষ। তার স্বামী এই মুহূর্তে জগতের সবচেয়ে নিঃসঙ্গ, সবচে একাকী ব্যক্তি। তার জন্যই এই আসন ফাঁকা থাকুক। আমি জানি না সে কি ধরনের মানুষ। জানি না যে তার বয়স কত। সে কি করে, বা কি করে না — এ সম্পর্কে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।
তার ব্যাপারে একমাত্র তথ্য যা আমার জানা আছে, তা হলো — তার কণ্ঠ বেশ পুরুষালি, তথা ভারী। কিন্তু এটুকু তথ্য তো কিছুই না। সেও কি নাবিকদের একজন? নাকি সে এক 'এন্টি-নাবিক', বা আমার মতো নাবিক-বিরোধীদের একজন? যদি সে পরবর্তী পরিচয়ের একজন হয়ে থাকে, তবে আমার সহমর্মীতা, আর শুভকামনা তার জন্য। আর যদি সে নাবিকদের একজন হয়ে থাকে... যাক, তবুও তার প্রতি আমার সহানুভূতি থাকবে। খুব খুশি হতাম, যদি তার শোক কমানোর জন্যে আমার তরফ থেকে কিছু করা সম্ভব হতো।
কিন্তু আমার প্রাক্তন প্রেমিকার স্বামীকে খুঁজে বের করার কোনো উপায় জানা নেই আমার। আমি তার নাম জানি না। সে কোথায় থাকে, তাও আমার জানা নেই। হয়তো ইতোমধ্যে তার আর কোনো নাম নেই, তার কোনো ঠিকানাও নেই। কেননা, এই মুহূর্তে তার মূল পরিচয় হলো — সে এখন পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ। যখন আমি হাঁটতে বেরোই, এবং হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে ইউনিকর্নের প্রস্তরমূর্তির সামনে বসি (ইউনিকর্ন, তথা মাথায় শিংওয়ালা ম্যাজিক ঘোড়ার মূর্তিবিশিষ্ট পার্ক আমার প্রতিদিনের হাঁটার পথে পড়ে), এবং আমি তার পাশে অবস্থিত ঠান্ডা পানির ঝরনার দিকে তাকাই, আমার এই লোকটার কথা মনে পড়ে।
তখন আমি মনে মনে অনুভব করার চেষ্টা করি, পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন হতে পারে। হ্যাঁ, পৃথিবীর দ্বিতীয় নিঃসঙ্গতম মানুষ হতে কেমন লাগে সেটা আমি জানি। কিন্তু নিঃসঙ্গতম মানুষের অনুভূতি আমার জানা নেই। পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ আর দ্বিতীয় নিঃসঙ্গতম মানুষের মধ্যে অনুভূতিজাত দূরত্ব অনেক। এক গভীর সমুদ্র — পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষ এবং পৃথিবীর দ্বিতীয় নিঃসঙ্গতম মানুষের পরিচয়কে পৃথক করে রেখেছে। গভীর, এবং প্রশস্ত। যে সমুদ্রের তলদেশে, এই সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রাণ হারানো পাখিদের হাড়গোড়ের পাহাড় জমে আছে।
এভাবে, হঠাৎ একদিন আপনি পরিণত হন নারীবিহীন পুরুষদের একজনে। এই দিনের আগমন ঘটে সম্পূর্ণ হঠাৎ করে, আপনাকে বিন্দুমাত্র ইশারা ইঙ্গিত দেওয়া ছাড়াই। দরজায় দাঁড়িয়ে কেউ গলা খাঁকড়ি দেবে না, কেউ টোকা পর্যন্ত দেবে না দরজার গায়ে। হুট করেই আপনি আবিষ্কার করবেন, যা ঘটার তা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে। কিন্তু আর ফেরার কোনো উপায় নেই। এই ঘটনাচক্রের আবর্তন শেষে আপনার পরিচয় থাকে কেবল একটিই। আপনি চিরকালের জন্যে বহুবচনে পরিণত হন। আপনি পরিণত হন 'নারীবিহীন পুরুষেরা'-তে।
শুধুমাত্র নারীবিহীন পুরুষেরাই অনুভব করতে পারে এটা কতোটা কষ্টদায়ক, কতোটা হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতা। সেই সুন্দর পশ্চিমা বাতাস চিরতরে হারিয়ে যায় আপনার জীবন থেকে। চৌদ্দ বছর বয়স ছিনিয়ে নেওয়া হয় আপনার কাছ থেকে সারাজীবনের মতো। 'চিরতরে', বা 'সারাজীবনের মতো' বলতে আসলে কি বোঝায়? লাখ - লাখ - লাখ - লাখ বছর, হয়তো-বা। দূর থেকে কেবল নাবিকদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে।
সমুদ্রের অতল গহিনে অচেনা সামুদ্রিক প্রাণীদের নজরবন্দি হয়ে থাকতে হয়। রাত ১টার পর ফোন করতে হয় একদম অপরিচিত কোনো ব্যক্তির কাছে, তার বাসগৃহে। রাত ১টার পর ফোন রিসিভ করা লাগে একদম অপরিচিত কোনো ব্যক্তির। জ্ঞান আর অজ্ঞতার মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা লাগে সম্পূর্ণ অপরিচিত কারো জন্য। গাড়ির টায়ারের হাওয়া পরীক্ষা করার ফাঁকে গাল থেকে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে শুকনো খটখটে রাস্তার ওপর।
ইউনিকর্ন স্ট্যাচুর পাশে বসে আমি মনে মনে প্রার্থনা করি, ওর স্বামী যেন একদিন পরিত্রাণ লাভ করে এই বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রার্থনাও করি যে, সে যেন কেবল তার মৃত স্ত্রীর 'এসেন্স' টুকু মনে রাখে, মনে রাখে তার অস্তিত্বের সার নির্যাস। আর সব যেন সে ভুলে যায়। তার মৃত স্ত্রীর অস্তিত্বের সারটুকু ছাড়া আর সব অপ্রয়োজনীয় তথ্য যেন সে ভুলতে পারে, পারে অতিক্রম করে আসতে।
আমি কামনা করি, সে যে ওসব ভুলে গেছে, তাও যেন সে ভুলে যেতে পারে। আমি সত্যি সত্যিই এমনটা অনুভব করলাম, তার ব্যাপারে। কল্পনা করা যায়, আমি ভাবলাম এই হচ্ছে পৃথিবীর দ্বিতীয় নিঃসঙ্গতম মানুষের তরফ থেকে পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম মানুষের প্রতি সৌহার্দ, সহানুভূতি (তাও এমন একজন মানুষের প্রতি, যার সঙ্গে তার কখনো দেখাও হয়নি)।
কিন্তু লোকটা আমাকে ফোন করবার প্রয়োজন বোধ করল কেন? সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমি প্রশ্নটা করছি না, আমি কেবল এই অত্যন্ত মৌলিক এক প্রশ্নের কোনো কুলকিনারা বের করতে পারছি না, এতদিন পরে এসেও। সে আমাকে কীভাবে চিনত? অথবা, চিনলেও, আমাকে তথ্যটা জানানোর প্রয়োজনই বা সে বোধ করল কেন? কারণটা সম্ভবত সহজ। 'ম' হয়তো তার স্বামীকে বলেছিল আমার কথা। বলেছিল আমার সম্পর্কে কিছু। এটাই একমাত্র কারণ হতে পারে লোকটার আমাকে ফোন করবার। যদিও আমার সম্পর্কে কি বলেছিল 'ম' তার স্বামীকে, সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তার জীবনে আমার আর কি গুরুত্ব থাকতে পারে যে, সে আমার মতো এক প্রাক্তন প্রেমিককে নিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে আলাপ করেছিল?
তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কিছু? তার মৃত্যুর সিদ্ধান্তের পেছনে কি আমার কোনো ছায়া সন্নিপাত ছিল? হয়তো আমার পুরুষাঙ্গ কতো সুন্দর ছিল, তা নিয়ে 'ম' আলাপ করেছিল তার স্বামীর সঙ্গে। বিকেলবেলায় যখন আমরা ঠায় অলসের মতন বিছানায় চিতকাত হয়ে পড়ে থাকতাম, সে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে আমার পুরুষাঙ্গ তার হাতের মুঠোয় পুরে ফেলত। তার চোখে মুখে বিস্ময়ের ঝিলিক দেখে মনে হতো, সে যেন সম্রাট শাহজাহানের গোপন সিন্দুক থেকে বের করে আনা একখণ্ড দামি হিরে হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছে। ‘বাহ, কিইইইই যে সুন্দর!’ সে বলতো আমার পুরুষাঙ্গের তারিফে। সত্যি সত্যি এমনটা বলত, নাকি বলার জন্যই বলত, আমি তা জানি না।
এসব আলোচনার সূত্র ধরেই কি তার স্বামী আমাকে ফোন করেছিল? রাত একটার পর সে আমাকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছিল, তার স্ত্রীর মুখে শুনে শুনে তারও আমার পুরুষাঙ্গের ব্যাপারে একটা সম্মানসূচক ধারণা তৈরি হয়েছিল বলে? মনে হয় না। এটা অ্যাবসার্ড। যেকোনো অ্যাঙ্গেল থেকেই তাকান না কেন, আমার পুরুষাঙ্গ অতো আহামরি কিছু নয়। বড়জোড় টেনেটুনে একে গড়পড়তা বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। তবে মেয়েটার সৌন্দর্য সম্পর্কিত বোঝাপড়া আমাকে বরাবরই অবাক করতো। খুব ভিন্নরকমের ছিল ওর নান্দনিক বোধের মাপকাঠি।
অথবা (আমি অনুমান করছি যে) ও আমাদের ছোটবেলার সেই ইরেজার ভাগ করবার কাহিনি বলেছিল ওর স্বামীকে। ওর কোনো গোপন উদ্দেশ্য ছিল না হয়তো এসব তথ্য শেয়ার করার পেছনে, হয়তো নেহায়েত সাদা মনেই করেছিল তা। অতীতের ছোট একটা তথ্য, যা সে ভাগ করে নিতে চেয়েছিল তার স্বামীর সঙ্গে। এটা নিশ্চয়ই তার স্বামীর মধ্যে হিংসা তৈরি করেছে। আমার সঙ্গে ইরেজার ভাগ করবার কাহিনি তাকে যতটুকু হিংসাতুর করেছে, 'ম' যদি দুই জাহাজভর্তি নাবিকদের সঙ্গেও উদ্যাম সঙ্গমে লিপ্ত হত, তাও তার স্বামীকে অতোটা হিংসাতুর করতো না।
এটাই তো হবার কথা। দুই জাহাজভর্তি নাবিক ওর জীবনে কি অর্থবহন করে? অন্যদিকে 'ম' আর আমি দুজনেই চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছিলাম, এবং তখন আমার পুরুষাঙ্গ শক্ত করে তুলবার জন্যে স্রেফ পশ্চিমা বায়ুর উষ্ণ একটি ঝাপটার প্রয়োজন ছিল। এই সময়কালে 'ম' এর মতো এক তরুণীর নিজের ইরেজার ভেঙে তার অর্ধেক আমার সঙ্গে শেয়ার করার ঘটনাটি ছিল অসাধারণ গভীর। এ যেন এক প্রলয়ঙ্করি টর্নেডোর হাতে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে ফেলার জন্য একডজন ফসলের গুদামঘর তুলে দেওয়ার মতো ঘটনা।
তারপর, পার্কে সেই ইউনিকর্নের স্ট্যাচুর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রত্যেকবার আমি কিছুক্ষণ বসে নারীবিহীন পুরুষদের কথা ভাবি। এই জায়গায়ই কেন? কেন একটা ইউনিকর্নের পাশে বসেই চিন্তা করা? কারণ, এই ইউনিকর্নও হয়তো নারীবিহীন পুরুষদের একজন। মানে, আমি কখনো কোনো ইউনিকর্ন দম্পতি দেখেনি যদিও। কাজেই পুরুষই তো হবার কথা ওর, তাই না? সর্বদা একাকী, খাড়া একখানা শিং আকাশের দিকে বাগিয়ে রাখা।
কাজেই ওকে হয়তো আমরা, নারীবিহীন পুরুষেরা, আমাদের প্রতীকচিহ্ন হিসেবে গ্রহণ করতে পারি। আমাদের সেই একাকিত্বের প্রতীক ও, যার ভার কাঁধে বহন করতে করতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গেছি। হয়তো আমাদের বুকপকেট আর টুপিতে ইউনিকর্নের ব্যাজ লাগিয়ে নিঃশব্দে সারা পৃথিবী হেঁটে বেড়ানো উচিত। হয়তো কোনো সঙ্গীত নয়, কোনো পতাকা উত্তোলন নয়, হাতে কোনো ব্যানার বা ফেস্টুন নয়। স্রেফ নিঃশব্দে হণ্টন, হয়তো। (‘হয়তো’ শব্দটা আজকাল আমি খুব বেশিই ব্যবহার করছি, হয়তো)
নারীবিহীন পুরুষে পরিণত হওয়া খুব সহজ। আপনার কোনো এক নারীকে খুব গভীরভাবে ভালোবাসতে হবে, তারপর সে নারীর স্রেফ আপনাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে অন্য কারো কাছে। ব্যস, এই তো! বেশি র ভাগ সময় (যেমনটা এতক্ষণে হয়তো আপনারা বুঝে গেছেন যে) এই অন্য কারো কাছে বলতে সাধারণত বাকপটু নাবিকদেরই বোঝানো হয়।
তারা তাদের চিনির সিরা মেশানো বাক্যবানে জড়িয়ে আপনার নারীকে তাদের সঙ্গে ভাগিয়ে নিয়ে যাবে অনেক দূরে, হয়তো মার্সেই, বা আইভরি কোস্ট। এবং তখন আমাদের কিছুই করার থাকে না। অথবা, সেই নারীদেরও আসলে সেই নাবিকদের ব্যাপারে কিছু করার থাকে না। অবশেষে তারা তখন আত্মহননের পথ বেছে নেয়। এই ব্যাপারেও আমাদের আসলে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। নাবিকদেরও না।
এভাবেই সাধারণত আপনি পরিণত হন নারীবিহীন পুরুষদের একজনে। নিজে কিছু বুঝে উঠবার আগেই। আর একবার নারীবিহীন পুরুষে পরিণত হবার পর একাকিত্ব চুয়ে চুয়ে প্রবেশ করতে থাকে আপনার শরীরের ভেতর। হালকা রঙের কার্পেটের ওপর গাঢ় রেড ওয়াইনের দাগ পড়বার মতো।
গৃহস্থালির পরিচ্ছন্নতাসংক্রান্ত যত বইই আপনি পড়ুন না কেন, ঐ দাগ উঠাবার মতো এলেম আপনি কখনোই অর্জন করতে পারবেন না। দীর্ঘকাল পর সেই দাগ হয়তো হালকা হয়ে যেতে পারে, কিন্তু একদম মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত ঐ দাগ আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী হয়ে থাকবে। যেন এই দাগ পরিণত হবে আপনার শরীরেরই এক অংশে। আর আপনাকেও ক্রমশ অভ্যস্ত হতে হবে ঐ দাগ, ঐ অস্পষ্ট রেখাচিত্রের সঙ্গে মিলেমিশে জীবন কাটানোয়।
নারীবিহীন পুরুষদের দুনিয়ায় সবকিছুই ভিন্ন। ভিন্ন সেখানে শব্দ। ভিন্ন তৃষ্ণার আঙ্গিক। ভিন্ন আপনার দাঁড়ি বড় হবার উপায়। স্টারবাকস আছে ঐ পৃথিবীতেও, কিন্তু তার কফির স্বাদ ভিন্ন। ক্লিফোর্ড ব্রাউনের গিটারের সোলো শুনতে ঐ জগতে ভিন্ন রকম লাগে। সাবওয়ে কারগুলোর দরজা খোলে আর বন্ধ হয় ভিন্ন উপায়ে।
ওম্যাটো স্যান্ডো থেকে আওয়ামা ইচোমা যেতে গিয়ে খেয়াল করবেন যে দূরত্ব আর পথ আর আগের মতো নেই। কোনো একজন নতুন নারীর সঙ্গে পরিচয় হলে, সে যত অসাধারণই হোক না কেন (আসলে সে যত অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হবে, এই কথা ততো বেশি সত্য বলে মনে হবে), তার সঙ্গে পরিচয়ের মুহূর্ত থেকে আপনার কেবল মনে হবে যে — আপনি ওকেও হারিয়ে ফেলবেন। সবসময়ই ঘাড়ের ওপর কোনো নাবিকের ছায়া অনুভব করবেন আপনি, শুনতে পাবেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ভাষায় (গ্রিক, বা এস্তোনিয়া, বা তাগালগ) তাদের ফিসফিস।
আপনি ভীত হয়ে উঠবেন ক্রমশ। দুনিয়াজোড়া সব বন্দরের সুন্দর সুন্দর নাম আপনাকে স্নায়বিকভাবে আরও দুর্বল করে তুলবে। কারণ নারীবিহীন পুরুষ বলতে যা বোঝায়, তার ব্যাপারে ইতোমধ্যে আপনার ধারণা হয়ে গেছে। আপনি হালকা রঙা এক পারস্যের কার্পেট, আর একাকিত্ব হচ্ছে বরদ্যু ওয়াইন, যার দাগ ওঠে না কখনো। একাকিত্ব ফ্রান্স থেকে আমদানি করা, আর ক্ষতজনিত কষ্ট হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের। নারীবিহীন পুরুষদের জন্য পৃথিবী এক বিশাল দুঃখের সংমিশ্রণ, অনেকটা চাঁদের আঁধারঘেরা দিকের মতোই।
'ম' আর আমার সম্পর্ক টিকেছিল বছর দুয়েক। খুব লম্বা সময় নয়। মাত্র দুবছর, আপনি বলতে পারেন। অথবা, দীর্ঘ দুই বছর। আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপার। যদিও আমি বলছি যে আমরা ‘দেখা করতাম’, তার অর্থ আসলে মাসে দুই থেকে তিনবার আমাদের দেখা হতো। এর পিছনে ওর নিজস্ব কারণ ছিল, আমারও ছিল, আমার মতো করে। একপর্যায়ে গিয়ে আমরা দুজনের একজনও আর চৌদ্দ বছর বয়স্ক ছিলাম না। সবমিলিয়ে আমরা আলাদা হয়ে যাই। এবং ঘটনাটা ঘটে আমার তরফ থেকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার প্রবল চেষ্টার পরেও। 'ম'-র চলে যাওয়ার পরেও নাবিকদের ঘন কালো ছায়া সারাজীবন প্রাসঙ্গিক রয়ে যায় আমার জীবনে, সরাসরি বা প্রতীকীভাবে।
'ম' এর সাংগীতিক রুচির ব্যাপারে আমার স্মৃতি সবচেয়ে স্পষ্ট। আমার মনে আছে কি গভীরভাবে সে পার্সি ফেইথ, মন্টোভানি, রেমন্ড লেফেভর, ফ্রাঙ্ক চ্যাক্সফিল্ড, ফ্রান্সিস লাই, ১০১ স্ট্রিংস, পল মাউরি, বিলি ভন ইত্যাদি মিউজিশিয়ানদের সঙ্গীত পছন্দ করত। সে সম্ভবত জন্মলগ্ন থেকেই এই সহজ সরল সুন্দর সঙ্গীতের জনরার প্রতি এক সহজাত আকর্ষণ তৈরি করে নিয়েছিল।
মৃদু সুরে গিটারের টুংটাং, একেবারে হালকা সুরে বেজে চলা ব্রাস, আর হার্পের তারে ক্ষিণ টোকায় সৃষ্ট ইন্দ্রজাল হৃদয়ের গভীরে গিয়ে অনুরণন সৃষ্টি করত। সেই সুন্দর সুর কখনো তাল বা লয়ছাড়া হতো না, এতো সুন্দর ছন্দে তা বেজে চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা, কোন আলাদা প্রচেষ্টা ছাড়াই যেমন করে নাকি জিহ্বার ওপর আলতো করে গলে যায় চকোলেট।
গাড়ি চালাবার সময় আমার রক বা ব্লুজ মিউজিক শুনবার অভ্যেস ছিল। 'ডেরেক অ্যান্ড দা ডমিনোস', 'ওটিস রেডিং', 'দা ডোরস'—ইত্যাদি। কিন্তু 'ম' কখনো আমাকে এসব ব্যান্ডের গান চালাতে দিতো না। ও ব্যাগে করে সবসময় ওর পছন্দসই সঙ্গীতের প্রায় একডজন ক্যাসেট সঙ্গে করে ঘুরত। ওগুলিই বাজতে থাকত একের পর এক। আমরা উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, ও হয়তো সঙ্গে সঙ্গে গুনগুন করে গাইতে থাকত ফ্রান্সিস লাই এর '১৩ জ্যু অ্যাঁ ফ্রান্স’।
ওর সুন্দর, সেক্সি ঠোঁটজুড়ে আবছা মতন লেগে থাকত লিপস্টিক। যাই হোক, মাঝে মাঝে মনে হতো যে ওর সংগ্রহে বোধ হয় হাজার দশেক গানের ক্যাসেট আছে। এবং দুনিয়ার ইজি গোয়িং, সোজা সাপটা সঙ্গীত বলতে যা বোঝায়, তার ব্যাপারে ওর চে' ভালো বোধহয় আর কেউ জানত না। এরকম সঙ্গীতের রেকর্ডিং সংরক্ষনের জন্যে যদি আলাদা একটা জাদুঘর খোলা হতো, তবে খুব সহজেই তার হেড কিউরেটর পদে ওকে নিয়োগ দেওয়া যেত।
আমাদের সঙ্গমের মুহূর্তেও ছিল সে একই নিয়ম। বিছানার পাশে মৃদুসুরে বাজতে থাকত গান। আমার এখন আর ঠিক মনেও নেই, ওর ভেতরে প্রবেশ করতে করতে কতোবার যে আমি পার্সি ফেইথের 'এ সামার প্লেস' গানটা শুনেছি। বলতে খানিকটা অস্বস্তিই লাগছে, এখনও এই গানটা শুনলে আমি ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে পড়ি। আমার শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত হয়ে ওঠে, চেহারা রক্তবর্ণ ধারণ করে।
সারা দুনিয়া খুঁজে হয়তো একজন মানুষকেই পাওয়া যাবে, এই আমাকে, যে কিনা 'এ সামার প্লেস' গানের শুরুর সঙ্গীতটুকু শুরু হলেই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। না, আমি একা নই, হয়তো তার স্বামীরও একই অবস্থা হয়। সেই সম্ভাবনাটুকুও গণনায় ধরে রাখা যাক। কাজেই, সারা দুনিয়া খুঁজে প্রকৃতপক্ষে দুজন মানুষ পাওয়া যাবে, যে কিনা ঐ গান শুরু হওয়ামাত্রই উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আমি, আর 'ম' এর স্বামী। এভাবে বলা যাক। তাহলে ঠিক হয় বক্তব্যটা।
শূন্যতা।
‘আমার এই ধরনের সঙ্গীতের প্রতি আকর্ষণ,’ 'ম' একদিন বলেছিল, ‘আসলে শূন্যতার সঙ্গে জড়িত একটা ব্যাপার। শূন্যতা?’ ‘যখন আমি এই ধরনের সঙ্গীত শুনি আমার মনে হয় যে আমি এক বিশাল বিস্তীর্ণ কোনো এক জায়গায় বিচরণ করছি। এতো বড় শূন্যতা সেখানে, চারপাশে তার কোন বেষ্টনী নেই। কোনো দেয়াল নেই, মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই। আমার কিছু চিন্তা করবার প্রয়োজন নেই সেখানে, নেই কিছু বলবার বা করবার প্রয়োজন। সেখানে স্রেফ থাকাটাই যথেষ্ট। আমি আমার চোখ বন্ধ করে বাজতে থাকা সঙ্গীতের মূর্ছনায় শরীর ভাসিয়ে দিই কেবল। কোনো মাথাব্যথা নেই সেখানে, নেই সর্দিগর্মির ব্যাপার, পিরিয়ড বা পিরিয়ড পরবর্তী কোনো সমস্যাও নেই। সবকিছু স্রেফ সুন্দর, শান্তিময়, প্রবহমান। ওখানে আমি স্রেফ আমি হয়ে থাকতে পারি নিশ্চিন্তে।’
‘বেহেশতের মতো?’
‘ঠিক তাই,’ 'ম' বলল। ‘আমি নিশ্চিত, বেহেশতে সবসময় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে পার্সি ফেইথ বাজতে থাকবে। আমার পিঠে আর একটু ম্যাসাজ করে দেবে?’ ‘নিশ্চয়ই,’ আমি উত্তর দিতাম। ‘তোমার পিঠ ম্যাসাজ তুলনাহীন।’ হেনরি মানচিনি আর আমি নিঃশব্দে দৃষ্টি বিনিময় করি একবার, আমাদের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'ম' এর পছন্দের মিউজিকও হচ্ছে আরেক বস্তু, যা আমি চিরতরে হারিয়েছি। প্রতিবার গাড়ি নিয়ে বের হবার সময় আমার মনে হয় এ কথা।
রেডিওর এক গান থেকে আরেক গান বদল হবার মুহূর্তটুকু আমি সর্বদা মনে মনে কামনা করি যে, জীবনে কখনো দেখা হয়নি এমন এক মেয়ে এসে ঢুকবে আমার গাড়িতে, বসে পড়বে সিটে, আর ক্যাসেট প্লেয়ারে 'এ সামার প্লেস' গানটা চালিয়ে দেবে। আমি স্বপ্নেও দেখেছি এমনটা। অবশ্যই এটা কখনো ঘটেনি। আমার গাড়িতে এখন আর কোনো ক্যাসেট প্লেয়ার পর্যন্ত নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে আমি ইউএসবি কেবলবিশিষ্ট একটি আইপড ব্যবহার করি। 'ফ্রান্সিস লাই' এবং '১০১ স্ট্রিংস' আমার আইপডে বাজে না কখনো। 'গরিলাজ' , অথবা 'ব্ল্যাক আইড পিইজ' বাজে, হয়তো-বা। তো, এই হচ্ছে নিজের পছন্দের নারীকে হারানোর খুঁটিনাটি ফিরিস্তি।
এবং এক পর্যায়ে এসে একজন নারীকে হারানো বলতে পৃথিবীর সব নারীকে হারানোই বোঝায়। এভাবে আমরা পরিণত হই নারীবিহীন পুরুষদের একজনে। আমরা হারাই আমাদের নারীর পছন্দের সমস্ত সঙ্গীত, তার জীবনে প্রাসঙ্গিক সব জীবজন্তু, আমরা হারাই তার শরীরের মসৃণতম পৃষ্ঠদেশ। 'মুন রিভার'-এর হেনরি মানচিনির ভার্শন শুনতে শুনতে আমি আমার হাতের তালু ঘষতাম ওর পিঠে। আরও কতো কতো গান... সব হারিয়ে গেল হুট করে। বাকি রইল খালি ওর ফেলে যাওয়া ভাঙ্গা ইরেজারের আধখানা টুকরা, আর দূর থেকে ভেসে আসা নাবিকদের মর্সিয়া। এবং পার্কে ফোয়ারার পাশে ইউনিকর্নের স্ট্যাচু, তার আকাশের দিকে তাক করা একাকী একটি শিং।
আমি আশা করি 'ম' এখন বেহেশতে বা বেহেশতের মতো কোনো জায়গায় বসে 'এ সামার প্লেস' শুনে সময় কাটাচ্ছে নিজের মতো করে। আবৃত হয়ে আছে সেই প্রশান্ত, প্রসারিত, দিগন্ত বিস্তৃত সঙ্গীতের সমুদ্রে। আশা করি সেখানে কেউ 'জেফারসন এয়ারপ্লেন' বাজাচ্ছে না কোনো স্টেরিওতে (ওর বড় না-পছন্দ এই ধরনের সঙ্গীত, খোদা এতোটা নির্মম হবেন না আশা করি)। আর সে যদি পিজিকাতো ভায়োলিনসের কাভার করা 'এ সামার প্লেস' শোনে, তাও বড় ভালো হবে, হয়তো সময়ে অসময়ে তার মনে হবে আমার কথা।
যাক, হয়তো খুব বেশি আশা করে ফেলছি আমি। এই প্রার্থনা করি যে, 'ম' খুশি আছে, শান্তিতে আছে, ওর পছন্দের কোনো মিউজিক ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজাতে বাজাতে। যদি আমি ওর সেই সুখ বা শান্তির অংশ নাও হই, তবুও, এই আমার প্রার্থনা। নারীবিহীন পুরুষদের একজন হিসেবে কায়মনোবাক্যে এসব কামনা করি। এই পর্যায়ে এসে প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার নেইও, হয়তো।