বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির প্রায় ৬০ ভাগ কৃষি শিল্পে জড়িত। কৃষি এখনও দেশের বৃহত্তর গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি এবং অধিকাংশ জনগণই জীবন, জীবিকা ও কর্মসংস্থানের জন্য কৃষির উপর নির্ভরশীল। কৃষি প্রযুক্তির আধুনিকায়নের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্যের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিসহ সামাজিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন সম্ভব।
টেকসই উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক, যুগোপযোগী ও উদ্ভাবনী প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ব্যাপক অগ্রগতি লাভের পাশাপাশি জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আনয়নে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। টেকসই কৃষি শিল্প একটি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা যার মূল লক্ষ্য কৃষকদের কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি সেগুলো সহজলভ্য ও সুলভ মূল্যে সরবরাহ করার মাধ্যমে আধুনিক, উদ্ভাবনীমূলক কৃষি শিল্পের প্রসার। ফলে জমি প্রস্তুতকরণ থেকে শুরু করে ফসল মাড়াই সবকিছু যান্ত্রিকীকরণের পাশাপাশি পরিবেশ বান্ধবও হবে। শুরু থেকেই আমাদের কৃষি প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল হওয়ার দরুণ বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি এবং উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততার কারণে আমাদের কৃষি উৎপাদন বরাবরই ব্যাহত হয়েছে। জমিতে অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমিগুলো ধীরে ধীরে উর্বরতা হারিয়েছে। নিকট ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন নিঃসন্দেহে কৃষির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে। তাই সংগত কারণেই আমাদের এখন থেকেই একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে কিছু স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা জরুরি।
টেকসই কৃষি শিল্পে মানুষের খাদ্য ও বস্ত্রের চাহিদা মিটাতে শস্য ব্যবস্থাপনার সাথে পশুপালন শিল্পকে এমনভাবে সমন্বয় করা হয় যাতে এর মাধ্যমে মাটি, পানিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পাশাপাশি ফসল উৎপাদন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টিও জড়িত থাকে। সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থাপনার মূল লক্ষ্য ভূমি ক্ষয় রোধের পাশাপাশি মাটির উর্বরতা রক্ষার্থে মাটির গুনাগুন অক্ষুন্ন রাখা, উৎপাদিত শস্যের পুষ্টি প্রক্রিয়ার পুনঃচক্রায়ন, প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় রোধের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য রক্ষা এবং প্রাণীজ আমিষের চাহিদা পূরণের সাথে সাথে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে পশুপালনকে উৎসাহিত করা। ‘পারমাকালচার’ আধুনিক কৃষিতে একটি নতুন সংযোজন। এটি মূলত স্থায়ী টেকসই কৃষি ব্যবস্থাকে নির্দেশ করে। শুধু ফসল উৎপাদনই পারমাকালচারের মূল উদ্দেশ্য নয়। একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং প্রকৃতির প্রতি যত্নশীল হওয়ার অভ্যাসও গড়ে উঠে এ প্রযুক্তির মাধ্যমে। পারমাকালচারে প্রকৃতির কোন ক্ষতি না করেই টেকসই ও সুশৃঙ্খলিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধতিতে কোন একটি নির্দিষ্ট ফসল উৎপাদন না করে এক সঙ্গে অনেকগুলো ফসল উৎপাদন করা হয় যার ফলে সেখানে একটি বাস্তুসংস্থানও গড়ে উঠে। পারমাকালচারে ফসলের উৎপাদন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হয়। কৃষিতে পারমাকালচারের মতো জৈব কৃষির ধারণাও নতুন নয় কিন্তু এটি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
ষাটের দশকের দিকে “সবুজ বিপ্লব” এর নামে বিশ্বজুড়ে ক্রমাগত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে জমি হারিয়েছে উর্বরতা, বাস্তুসংস্থান নষ্টের পাশাপাশি হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী। মাটিতে বসবাসকারী অনুজীবেরা মাটিতে জৈব সার হিসেবে কাজ করে, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে, কিন্তু অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে এরা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। একটি টেকসই কৃষি ব্যবস্থার লক্ষ্যে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে জৈব কৃষি নিয়ে।
মূলত জৈব কৃষি একটি বাস্তবসম্মত পদ্ধতি, যা ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি টেকসই পরিবেশেরও নিশ্চয়তা দেয়। এ উপায়ে উদ্ভাবিত পণ্যকে বলা হয় অর্গানিক ফুড। জৈব কৃষিতে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে খামারজাত সার, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা, হাড়ের গুড়া, ছাই, কেঁচো ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এবং কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয় কান্ড, পাতা, মূল ও বাকলের রস দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একদিকে যেমন আমাদের খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি অন্যদিকে আমরা আমাদের চাষাবাদের জমি হারিয়ে ফেলছি। এক্ষেত্রে বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের জোগান দিতে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ প্রক্রিয়া হতে পারে একটি বিকল্প সমাধান। মাটি ছাড়াই যেহেতু চাষাবাদ সম্ভব সেহেতু পানিতে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান যোগ করে পানিতেই ফসল উৎপাদন করা হয়। এ পদ্ধেিত পোকা-মাকড় নিয়ন্ত্রণ করাও তুলনামূলকভাবে সহজ। এ প্রক্রিয়ায় কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন ঘাস একসঙ্গে স্তুপ করে পঁচিয়ে ভাসমান বেড তৈরি করে সেখানে ফসল চাষ করা হয়।
টেকসই কৃষি ব্যবস্থার লক্ষ্যে আবহাওয়া সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকা জরুরি। উন্নতদেশে কোন নির্দিষ্ট এলাকায় নির্দিষ্ট ফসল ফলানোর ক্ষেত্রে সে এলাকার আবহাওয়া, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, শিশির, বাষ্পীভবন, তাপমাত্রা, লবণাক্ততা, মাটির গুনাগুন এবং সম্ভাব্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে ঐ এলাকার জন্য উপযুক্ত ফসলের জাত নির্বাচন করা হয় তাই কৃষক পরিবেশ ও প্রাকৃতিক কোন কারণে সম্ভাব্য ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান এবং ফসলের উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিকায়নের পাশাপাশি উন্নত, সময়োপযোগী ও আধুনিক বাজারব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। মনে রাখা দরকার টেকসই কৃষিব্যবস্থা আমাদের খাদ্যের নিশ্চয়তার পাশাপাশি টেকসই পরিবেশেরও নিশ্চয়তা দেয়। তাই আগামীর কথা চিন্তা করে দেশে এখন থেকেই টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত।
জান্নাতুল ফেরদৌস
পরিবেশ বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইমেইল: jannat18103437@gmail.com