শনিবার , ০৫ অক্টোবর ২০২৪

আনি এরনোর ‘দ্য ইয়ারস’ এবং ‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’

দেশকাল অনলাইন   বৃহস্পতিবার , ০৩ নভেম্বর ২০২২

ছবি : ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।

নোবেলজয়ী লেখক আনি এরনোর উপন্যাসগুলোর ধারাবাহিক রিভিউর দ্বিতীয়পর্বে আজ প্রকাশিত হলো ‘দ্য ইয়ারস’ এবং ‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’। রিভিউ দুটি নেয়া হয়েছে ‘কমপ্লিট রিভিউ’ থেকে। 

‘দ্য ইয়ারস’
দ্য ইয়ারস আনি এরনোর অন্যান্য স্মৃতিকথামূলক রচনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। শুধুমাত্র লেখকের আত্মকথন নয় উপন্যাসটি। তিনি এতে আমাদের প্রজন্মের কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে এতে সমগ্র জাতির আত্মকথন রয়েছে। উপন্যাসের ‘আমি’-কে শুধু উপস্থাপনের জন্য ‘এক’ হিসেবে ধরে নিতে পারি কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা ‘আমরা’-এর গল্প বলে।

দীর্ঘ এই উপন্যাসে কালানুক্রমিক অগ্রগতির মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের(এরনো জন্ম ১৯৪০ সালে)কাছাকাছি সময় থেকে বর্তমান সময়ের চিত্র পাওয়া যায়। এতে ফটো-অ্যালবাম দেখার মতো অনুভূতি রয়েছে। লেখকের লক্ষ্য হয়তো ছিলো জীবনকে গল্পে স্থাপন করা। জীবন সম্পর্কে নিজের ব্যাখ্যা তৈরি করার।তিনি কেবল নিজের মধ্যেই পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করতে চান। অতীতের ধারণা, বিশ্বাস, সংবেদনশীলতা, পরিবর্তন, মানুষের রূপান্তর এবং তিনি যে বিষয়গুলো প্রত্যক্ষ করেছেন তা কেবল তিনিই উপলব্ধি করতে পারবেন এমন একটি বিষয়গত ধারণা পাওয়া যায় উপন্যাসের পৃষ্ঠাগুলোর আড়ালে।

উপন্যাসের শুরুতে শৈশবের টুকরো টুকরো স্মৃতি-বিস্মৃতির খন্ড চিত্র দেখিয়ে লেখক ফিরে যান তার সমৃদ্ধ স্মৃতির দিকে। অধ্যয়নের ধরন, খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা, কথোপকথনের বিষয় এবং উদ্বেগের বিষয়গুলো উপন্যাসে তিনি সচেতন ভাবে তুলে ধরেছেন। পারতপক্ষে, এসব তৎকালীন সমাজের শ্রেণীবৈষম্যকে ইঙ্গিত করে। লেখক নিজেই এসবের ভুক্তভোগী ছিলেন। এভাবে গল্প শেষপর্যন্ত এসে থেমে যায় তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে।


তিনি যুদ্ধোত্তর সামাজিক কাঠামো এবং মানুষের মনোভাবের পরিবর্তনগুলো সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে লক্ষ্য করেছেন। যেমনঃ যুদ্ধোত্তর মানুষের জীবনযাপন ঝুঁকতে থাকে প্রযুক্তি এবং ভোগবাদের দিকে, যৌনতার দিকে(জন্মনিরোধক পিলের বৈধতা বর্ণনা মাধ্যমে তা তুলে ধরেছেন)। ব্যক্তিগত ল্যান্ডলাইন টেলিফোন থেকে মুঠোফোন, টেলিভিশন এবং শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারের আবির্ভাব মানুষের জীবনযাপনে কীভাবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে তা তিনি লক্ষ্য করেছেন। এসব পরিবর্তনের পাশাপাশি তিনি শৈশবের বিচ্ছেদ এবং পার্থক্য থেকে শুরু করে যৌনতার সমস্যা নিয়ে কীভাবে ছেলে-মেয়েরা এবং নারী-পুরুষেরা একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত তাতেও দৃষ্টিপাত করেছেন ।

প্রথম দিকে, সাহিত্য-সংস্কৃতির দিকে দৃষ্টি রাখলেও শেষদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সামগ্রিক রুপ সচেতন ভাবে তুলে ধরেছেন। এরমধ্যে এইডস সংকট, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, নাইন ইলাভেনের হামলা উল্লেখযোগ্য। সেগুলো তার জীবনের বৃহত্তর প্রবাহে মিশে গেলেও চিহ্নিত পরিবর্তনগুলো সহজভাবে তার এই স্মৃতি প্রবাহে ধরা পড়ে। উদাহরণস্বরূপ উপন্যাসের একটি লাইনের কথা বলা যায়, “যে বছরগুলো জমেছে, আমাদের ল্যান্ডমার্কে, ১৯৬৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত, সবই মুছে ফেলা হয়েছে।” কীভাবে স্মৃতি বদলে যায়, বিবর্ণ হয়ে যায় অতীত। কীভাবে অতীতের তাৎপর্য ঘটনাও স্মৃতিতে দুর্বল হয়ে পড়ে। তবুও কিছু ঘটনা আমাদের মনে উজ্জ্বল এবং প্রাণবন্ত রয়ে যায় তার গল্পই বলে যায় দ্য ইয়ারস উপন্যাসটি ।

‘আই রিমেইন ইন ডার্কনেস’
আশির দশকের গোড়ার দিকে আনি এরনোর মা একটি দূর্ঘটনায় শারীরিক ও মানসিকভাবে আহত হয়ে পড়ে। তখন মায়ের সাথে কাটানো দুর্বিষহ স্মৃতিগুলোকে তিনি কথাসাহিত্যের আদলে দিনলিপি মাধ্যমে এই বইতে তুলে ধরেছেন। ১৯৮৩ সালের দিকে তার মা আলঝেইমা রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং ১৯৮৬ সালের এপ্রিলে হার্ট অ্যাটাক এবং পরবর্তীতে মায়ের মৃত্যুর অর্থাৎ মায়ের অবনতিশীল স্বাস্থ্যের নিঃশব্দ ও বিস্ময়কর বিবরণ রয়েছে উপন্যাসে। প্রথম দিকে এরনো এবং তার সন্তানদের সাথে তার মা বসবাস করতেন। কিন্তু স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় পরে তাকে একটি বৃদ্ধাশ্রমে দেওয়া হয়। মায়ের স্বাস্থ্যের এই ধীর অবনতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে এরনো দিনলিপি লিখতে থাকেন। তার মা কীভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতোন আচরণ করত। শিশুদের ডায়াপার পরে কোলোনের গন্ধভরা ঘরটিতে বসে থাকত তা তিনি ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করতেন।

এরনো এসবের পাশাপাশি নিজের অভিব্যক্তিও লিপিবদ্ধ করেছেন। মায়ের ভারসাম্যহীন আচরণের জন্য দোকানদারেরা তার মা-কে অবজ্ঞার চোখে দেখলে তিনি রেগে যেতেন। মায়ের ভুলের জন্য তিনি বার বার হতাশ হয়ে পড়তেন।এসব কারণে অপরাধবোধ জন্মালেও বছরের পর বছর তিনি মায়ের সাথে অতিবাহিত করেছেন। আবেগহীন থাকার চেষ্টা করেছেন। অবশেষে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি একেবারে ভেঙে পড়েন।


এরনোর অন্যান্য রচনার মতো এই উপন্যাসটিও আত্মজৈবনিক অর্থাৎ ‘জীবনের একটি অংশ পুনরুদ্ধারের প্রয়াস’ বলা যায়। নিখুঁত বিবরণের পাশাপাশি চিন্তাশীল এবং কাব্যিক ভঙ্গিতে সাধারণ স্মৃতিকথাগুলো উপন্যাসে সাজানো হয়েছে। পুরনো সময়ে ফিরে বিশেষ করে শৈশব এবং মা ও মেয়ের সম্পর্কের বেশী স্মৃতিচারণ করেছেন। এরনো ভাবে জন্মদাত্রী জননীকে এভাবে সময়ের সাথে সাথে গ্রাস হওয়া থেকে তিনি কেবল চিত্রশিল্পের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার করতে পারবেন।

উপন্যাসটি বৃদ্ধ বয়সের অপ্রীতিকর অবস্থা এবং নিগূঢ় বাস্তবতার সাথে স্মৃতির সমন্বিত একটি রুপ। এরনো বরাবরের মতোই অকপট তার লেখনীতে। বিস্ময়কর এই লেখক ছোটোখাটো সমস্যাগুলোতেও তিনি কীভাবে ভালো এবং সহজভাবে অতিক্রম করছেন তা প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসের এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে জীবন খুবই অপ্রীতিকর ও অপ্রত্যাশিত। অবশ্যই তার মায়ের এই পরিণতি তার জন্য অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং এও সত্য অনেকগুলো জীবনকে স্পর্শ করেও গল্পটি এখনকার দিনে খুবই সাধারণ। তবে গল্পে সামান্য আশা আছে, এবং শেষপর্যন্ত এতে সামান্য শিল্পবোধও রয়েছে। চলবে

দৈনিক দেশকাল/শেখ/৩ নভেম্বর, ২০২২



 সাহিত্যাঙ্গন থেকে আরোও সংবাদ

ই-দেশকাল

আর্কাইভ