আনন্দ কুমার সেন, ঢাকা : ডা. এস এ মালেকের প্রতিভা ছিল অসাধারণ। রাজনীতি, চিকিৎসাবিদ্যা, সমাজনীতি, আন্তর্জাতিক বিশ্ব, অর্থনীতি প্রভৃতি বিষয়ে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তার মৃত্যুতে দেশ একজন প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবীকেই হারাননি, একজন সৎ, নিবেদিতপ্রাণ, যোগ্য, দক্ষ ও আদর্শবান রাজনীতিবিদকে হারিয়েছে।
তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। একজন আদর্শ মানুষের যেসব চারিত্রিক গুণাবলি থাকা দরকার, তার সবগুলোই ডা. এস এ মালেকের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। দেশ ও জাতির কল্যাণে ডা. এস এ মালেক নিরবে-নির্ভৃতে কাজ করে গেছেন।
ডা. এস এ মালেক সম্পর্কে লেখা আমার পক্ষে কষ্টসাধ্য বিষয়। কারণ তার বহুমুখী প্রতিভা ও কর্মকান্ডের বিষয় তুলে ধরে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদরা পর্যালোচনা করবেন। আমি শুধু সাংগঠনিক কার্যক্রমে তার সাথে ঘনিষ্টভাবে মেশার সুযোগ হয়েছে বিধায় লেখার ফাকে তিনি গল্প শোনাতেন ও রাজনীতির ইতিহাস তুলে ধরতেন, সেই স্মৃতি কথা থেকেই কিছু লেখার চেষ্টা করছি।
ডা. এস এ মালেক একজন ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গণে তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে তিনি অবদান রেখেছেন। জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তিনি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছেন।
একজন সফল রাজনীতিবিদ, প্রতিথযশা বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, লেখক-কলামিস্ট, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক উপদেষ্টামন্ডলির অন্যতম সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সভাপতি, সাবেক জাতীয় সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. এস এ মালেকের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত।
একজন মানবতাবাদী, আদর্শবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মুর্তপ্রতিক ছিলেন ডা. এস এ মালেক। আমি একজন রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তি হিসেবে ডা. এস এ মালেকের আর্টিকেল পড়তাম। তাছাড়া আমার বড় বোন প্রতিভা রানী সেন নিয়মিত স্যারের লেখা পড়তেন। এই থেকে স্যারের একজন ভক্ত হয়ে যায়। ১৯৮৫ সালের দিকের কথা। তখন স্বৈরাচারী এরশাদের রাজত্বকাল। রাজনীতি করা কঠিন। সেই দুঃসময়ে আমি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের একজন সমর্থক ও কর্মী হিসেবে রাজপথে কাজ করেছি।
কুষ্টিয়াতে তখন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি মতিউর রহমান লাল্টু সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। দেশবরেণ্য বুদ্ধিজীবী স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, অধ্যাপক আব্দুল খালেক, বিচারপতি কে এম সোবহান, কবি শামসুর রহমান, ডা. এস এ মালেক, বঙ্গবন্ধু পরিষদের অনুষ্ঠান গুলোতে আসতেন। এভাবে ডা. এস এ মালেকের সাথে ঘনিষ্ঠতা।
তিনি ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতির উপদেষ্টার দায়িত্ব পেলে মতিউর রহমান লাল্টুর সুপারিশে আমি ডা. এস এ মালেকের সাথে কলাবাগানের বাসায় দেখা করি। তখন আমি নির্বাচন কমিশনে উচ্চমান সহকারী পদে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম এবং স্যারের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্য যেন আমার চাকুরীটা হয়।
তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, এখানে তেমন কিছু করার নেই। তার পরেও বললেন দেখি। অবশ্য ওই চাকরিটা আমার হয়নি। আমি বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলার কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি দায়িত্ব পেলে তখন স্যার এই সংগঠনের উপদেষ্টামন্ডলির সদস্য ছিলেন। আমি কর্মের তাগিদে ঢাকায় অবস্থান করায় ২০১৩ সালে দিকে বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতা মতিউর রহমান লাল্টু ভাই বললেন, ডা. এস এ মালেক এর একজন ব্যক্তিগত সহকারী প্রয়োজন। আমি প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। জানি তার মতো গুণীজনের সান্নিধ্য পাওয়া বড় কঠিন ব্যাপার।
এই থেকে স্যারের আর্টিক্যাল ডিকটেশন নিয়ে পত্রিকায় পাঠানো, বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাংগঠনিক কাজকর্মের সাথে সক্রিয় ছিলাম। স্যার যখনই ডেকেছেন, ছুটে চলে গিয়েছি। আমি আজ এ কথা বলতে পারি এমন একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে আমি ধন্য ও আলোকিত হয়েছি। আমি অসুস্থ হলে তিনি আমাকে সার্বিক খোঁজখবর নিতেন। তার চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছি।
স্যারের মৃত্যুর ৩ মাস আগে আমি ঢাকায় আসলে স্যারের সাথে দেখা করি। স্যার বললেন, তোমাকে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে রাখা হয়েছে। নীতি নির্ধারণী জায়গায় তোমার অবস্থান। ভালোভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করে যাবে। এসময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অরুন কুমার গোস্বামী স্যার উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা একশত গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এর মধ্যে অরুন কুমার গোস্বামীর লেখা গ্রন্থ ডা. এস এ মালেক স্যারকে উপহার দিলেন। স্যার এই কথায় বললেন, আনন্দ কুমার সেনকে দেখে রাখবেন।
ডা. এস এ মালেকের প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা ও বিচক্ষণতা সকলকে মুগ্ধ করে। তিনি প্রায়ই বলতেন, শিক্ষকরাই জাতির বিবেক। আগামী দিনে আমার অনুপস্থিতিতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বঙ্গবন্ধু পরিষদের নেতৃত্বে থাকবেন। আজ স্যারের সেই চিন্তা, চেতনা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। সভাপতি ভারপ্রাপ্ত পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক পদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক নির্বাচিত হয়েছেন।
ডা. এস এ মালেক চার দশক ধরে বঙ্গবন্ধু পরিষদের সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। তিনি চিকিৎসা সেবায় যে অর্থ উপার্জন করতেন, তার থেকে কিছু অংশ সংগঠনের জন্য ব্যয় করতেন। তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেও ভোগ-বিলাস, প্রাচুর্য তিনি পছন্দ করতেন না।
বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে একটি মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-ধারণা। তিনি শোষণ-বৈষম্যহীন, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশের কথা ভাবতেন। এমন একজন গুণী মানুষকে হারিয়ে আমি একজন অভিভাবককে হারালাম।
মৃত্যু চিরন্তন, জীব মাত্র মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবেন। তিনি চলে গেছেন; কিন্তু রেখে গেছেন তার কর্ম ও আদর্শ। দেশ বিদেশে লক্ষ ভক্ত ও অনুসারী। এদের মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন। গত ৬ ডিসেম্বর ২০২২ দিবাগত রাত ১১.১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়াবন্ধ হয়ে ৮৮ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আমি এই মহান নেতা বেহেস্তের সর্বশ্রেষ্ঠ সুন্দরতম স্থানে অধিষ্ঠিত থাকুন, পরম সৃষ্টিকর্তার নিকট কায়মনোবাক্য সেই প্রার্থনাই করি। আলোকচিত্র শিল্পী ফোজিত শেখ বাবু ‘ডা. এস এ মালেকের স্মৃতি’ ‘শ্রদ্ধা’ শিরোনামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দুই দিনব্যাপী বঙ্গবন্ধু পরিষদের ১৫ বছরের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ছবি নিয়ে আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। আমি এজন্য আলোকচিত্র শিল্পী ফোজিত শেখ বাবুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। তার পথ চলা সুন্দর ও সার্থক হোক সেই কামনা করি।
লেখক : সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধু পরিষদের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা