অজয় দাশগুপ্ত:
ভিয়েতনাম: গেরিলা যুদ্ধের কাহিনী- বইটি প্রথম পড়ি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালেত্রিপুরার জঙ্গলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাক্রমশালী শক্তিকে পরাভূত করার জন্য ভিয়েতনামের জনগণ মহান নেতা হো চি মিনের আহ্বানে গেরিলা যুদ্ধের যে কৌশল গ্রহণ করেছিল এবং কীভাবে তা সফল করে তোলা হয়েছিল, পাতায় পাতায় রয়েছে এর বিবরণ। আমরা প্রত্যেকেই পাই প্রেরণা। আমাদের সঙ্গে অনেক তরুণ ছিল, যাদের স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ ঘটেনি। আমরা তাদের ভিয়েতনামের গেরিলাদের অসম সাহসী অভিযানের কথা পড়ে শোনাই। তারাও কণ্ঠ মেলায়- ভিয়েতনামের পথ ধর বাংলাদেশ মুক্ত কর স্লোগানে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ততক্ষণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজধানী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করেছে। তিনি ঘোষণা করেনÑ পাকিস্তান এখন থেকে শত্রুরাষ্ট্র, তাদের পরাভূত করার জন্য যার যা আছে তাই নিয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এ আহ্বান ৭ মার্চ রেস কোর্সের জনসভা থেকেও এসেছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, রাস্তাঘাট সব কিছু বন্ধ করে দেবে। আমরা তাদের ভাতে মরাব, পানিতে মারব... এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব। এটাতো গেরিলা যুদ্ধেরই কৌশল।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানের দুই যুগের অস্তিত্বকালের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি কাটিয়েছেন কারাগারে। তবে এ বন্দীজীবন ছিল এ ভূখণ্ডের ঢাকাসহ কয়েকটি কারাগাওে সীমিত। কিন্তু ২৫ মার্চের পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তান ভূখণ্ডে, যা পরিণত হয়েছিল ‘শত্রুরাষ্ট্রে’। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে রণাঙ্গনে পরাভূত করার জন্য গেরিলা কৌশল ও সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক অভিযানও সফলভাবে পরিচালনা করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনাম ছিল পথপ্রদর্শক এবং বড় প্রেরণা।
এ দেশটি ১৯৫৪ সালে উপনিবেশিক শক্তি ফ্রান্সের সুদক্ষ সেনাবাহিনীকে পরাভূত করে। এরপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিপুল সামরিক শক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে ভিয়েতনামের একটি অংশে তাবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। এর বিরুদ্ধে শুরু হয় হো চি মিনের নেতৃত্বে নতুন করে সশস্ত্রসংগ্রাম। গেরিলা যুদ্ধ ছিল তারই অংশ। মার্কিনীরা স্থল ও বিমান হামলা চালিয়ে ভিয়েতনামের মুক্তিবাহিনীকে দমন করতে বার বার হামলা চালায়। বিশ্বব্যাপী নিন্দা ধ্বনিত হয় এর বিরুদ্ধে। কারাগারে থেকেও বঙ্গবন্ধু মার্কিন হামলার নিন্দা করেন। ১৯৬৬ সালের ৯ জুলাই তিনি লিখেছেনÑ ‘ভিয়েতনামের হ্যানয় ও হাইফং-এ আবারও বোমাবর্ষণ করেছে আমেরিকা। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে একটা মূলতবী প্রস্তাব হ্যানয় ও হাইফং বোমাবর্ষণের ব্যাপার নিয়ে এনেছিল বিরোধীদল। কিন্তু স্পিকার নাকচ করেছেন।’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১৫৩-১৫৪]
ভিয়েতনামের জনগণ জয়ী হবে, এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিঃসন্দেহে। তিনি লিখেছেনÑ ‘আমেরিকা নিজেকে যতই শক্তিশালী মনে করুন, রাশিয়া যখন হ্যানয় সরকারকে সাহায্য করতে আরম্ভ করেছে তখন যুদ্ধে কখনই জয়লাভ করতে পারবে না। ... উত্তর ভিয়েতনাম ঘোষণা করেছে, মার্কিন পাইলটদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিচার করা হবে না, বিচার করা হবে যুদ্ধ-অপরাধী হিসেবে। অন্যায়ভাবে অন্যের দেশে বোমাবর্ষণ করা, যুদ্ধ ঘোষণা না করেÑ এর চেয়ে ভাল ব্যবস্থার আশা করতে পারে কি?’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা ১৬০ ও ১৭৪]
বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। এর দুই মাস যেতে না যেতেই ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তবে এ দেশটির বড় অংশ তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত তাবেদার সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এদের হটাতে চলছে গেরিলা যুদ্ধ। লাখ লাখ মার্কিন সেনাসদস্য তাবেদার সরকারের হয়ে লড়ছে গেরিলাদের বিরুদ্ধে। চলছে নির্বিচারে বোমা হামলা। এ সময়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দিত-ধিকৃত হতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বাংলাদেশও অনেক রাজনৈতিক-সামাজিক সমাবেশে ভিয়েতনামের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হয়। ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে বাংলা একাডেমিতে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের একটি প্যাভিলিয়ন বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানিয়ে ব্যানার টানিয়ে দেয়। পরে ছাত্ররা তোপখানা রোডের মার্কিন তথ্য কেন্দ্রও বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি এই তথ্য কেন্দ্রের সামনেই ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানাতে আসা ছাত্রদের সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে মতিউল ইসলাম ও মির্জা কাদের নামে দু’জন ছাত্র নিহত হয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার ঘৃণা আরও প্রবল হয় এবং ভিয়েতনামের প্রতি সমর্থন বেড়ে যায়। দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তি আন্দোলন বেগবান করার জন্য গঠিত অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কূটনৈতিক স্বীকৃতি প্রদান করেন। শুধু তাই নয়, ঢাকায় এ সরকারের অফিস স্থাপনের জন্য বিনা মূল্যে একটি বাড়ি বরাদ্দ করেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ ছিল না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর স্পষ্ট জবাব ছিলÑ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভিয়েতনাম ছিল প্রেরণা। আমাদের ছাত্র-জনতা স্লোগান দিয়েছেÑ তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি, এখন ভিয়েতনামের পাশে থাকব। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাসে ভিয়েতনাম মার্কিন বাহিনী ও তাদের তাবেদাররা পরাস্ত হলে বাংলাদেশের নানা স্থানে তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল বের হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ ধরনের একটি মিছিলে আমিও অংশ নিয়েছি।
ভিয়েতনাম কখনও কোনো দেশের কাছে মাথা নত করেনি। বাংলাদেশকেও কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি, পারবে না। ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু আয় ১৯৭৪ সালে ছিল ৬৫ ডলার, এখন তা তিন হাজার ডলারের কাছাকাছি। বাংলাদেশও গত পাঁচ দশকে একই ধরনের অর্থনৈতিক সাফল্য প্রদর্শন করতে পেরেছে। আমাদের মাথাপিছু আয়ও ভিয়েতনামের সমপর্যায়ে। বহু বছর বাস্কেট কেস হিসেবে অভিহিত বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের সারি থেকে মুক্ত হয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। উন্নত বিশ্বের সারিতে স্থান করে নেওয়াও আর স্বপ্ন নয়। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে বিশ্বব্যাপী ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের অর্জনকে অভিহিত করা হচ্ছে ‘মিরাকল’ হিসেবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম মরণপণ লড়াই করেছে। কিন্তু নিজের অর্থনীতি দৃঢ় ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রফতানি বাণিজ্য ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা দেশের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগও তারা গ্রহণ করছে। জাতীয় স্বার্থ বজায় রেখেই ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্বের নীতি’ ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশও অনুসরণ করে চলেছে। প্রতিবেশী ভারত, পাশের বৃহৎ শক্তি চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-জাপান-রাশিয়া ও ইউরোপের ধনী দেশসমূহ, সবার সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলার কৌশল সুফল দিচ্ছে। ভিয়েতনামও একই কৌশল অনুসরণ করছেÑ যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়াÑ সকল দেশের সঙ্গেই অর্থনৈতিক সহযোগিতার নীতি ও কৌশল অনুসরণ করা হয় ।
বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমাগত জোরদার হচ্ছে। এ বছর দুই দেশের বাণিজ্য ২০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত হয়েছে। রফতানি বাণিজ্যকৌশল এবং কৃষিতে দুটি দেশই সফল। পরস্পরের কাছ থেকে শিক্ষা নিতেও আগ্রহ প্রবল। ভিয়েতনামের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা বাংলাদেশে এসেছেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফর করেছেন ভিয়েতনাম।
ভিয়েতনাম প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের দেশ। কিন্তু মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রফতানি বাড়াতে তারা ‘হালাল পণ্য’ উৎপাদন বাড়ানোর কৌশল নিয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ভিয়েতনামে এ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে প্যানেল বক্তা হিসেবে রাখা হয়েছিল। সম্মেলনে বলা হয়, ২০২৪ সালে বিশ্বে হালাল খাদ্যের বাজার দাঁড়াবে ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলার। আর ২০৫০ সালে এ বাজারের পরিমাণ হবে ১৫ ট্রিলিয়ন ডলার। ভিয়েতনাম এ বাজারের হিস্যা বাড়াতে চায়। ভারতে এখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু সেখানেও মুসলিম বিশ্বের বাজার ধরার জন্য হালাল খাদ্য-ওষুধ উৎপাদনের আয়োজন রয়েছে। বাংলাদেশ তাদেরকাছ থেকে এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিতে পারে।
ভিয়েতনাম পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোট আসিয়ানের সদস্য। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশ নিয়ে গঠিত এ জোটের সদস্যদের মধ্যে রাজনৈতিক কাঠানো, ধর্মবিশ্বাস ও অর্থনৈতিক নীতিতেবিস্তর পার্থক্য। কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারেপ্রতিটি দেশই উদ্যোগী এবং এতে সকলেই লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশ এ থেকেও শিক্ষা নিতে পারে।
এখন দুটি দেশই ভিন্ন ধরনের লড়াইয়ে- উন্নত বিশ্বের সারিতে পৌঁছে যাওয়া। তবে মানবিকতাও জেগে আছে। ভিয়েতনামের বাংলাদেশ দূতাবাস কয়েকবার আয়োজন করেছে রক্তদান কর্মসূচির। করোনার সময় দূতাবাস থেকে খাদ্য বিতরণ কর্মসূচিও নেওয়া হয়েছিল। আগামীতে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি মানবিকতার ধারাও বেগবান হবে, এতে সন্দেহ নেই।
কূটনৈতিকসম্পর্কের সুবর্ণ জয়ন্তী এ বছর। তবে সম্পর্ক আরও অনেক পুরানো। বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম বিপুল আত্মত্যাগে অর্জন করেছে স্বাধীনতা। উভয় দেশের অনেক স্থান ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত’। কোথাও গণকবর, কোথাও শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে রণাঙ্গনে সাফল্যগাথার স্মৃতি। দুই দেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিভরা এ স্থানসমূহ নতুন প্রজন্মের জন্য নিয়মিত পরিদর্শনের আয়োজন হতেই পারে।