চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এরই মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে ওষুধের বাজারেও। চলতি বছরের মে ও আগস্টে দুই দফা দাম বাড়ানোয় বেঁচে থাকার জন্য ভাতের যোগান দেবেন নাকি সুস্থতার জন্য ওষুধ কিনে খাবেন- এমন দোটানা পরিস্থির মধ্যে পড়েছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষেরা। যদিও বিষয়টিকে মূল্যবৃদ্ধি বলতে রাজি নন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো, এমনকি ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও। তাদের মতে, ডলারের মান, কাঁচামাল আমদানি ও উৎপাদান খরচের সাথে দামের সমন্বয় করা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে সরেজমিনে অগণিত চিকিৎসাপ্রার্থীর সঙ্গে কথা হয় ওষুধের দাম নিয়ে। তেমনি এ গল্পের প্রথম জন স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি। তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা। তার সঙ্গে দেখা হয় রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে। আবার এখানেই দেখা মেলে ষাটোর্ধ্ব জহিরুল হকের সাথেও। জহিরুল ২০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এখানেই শেষ নয় একবার হার্ট অ্যাটাক ছাড়াও আছে আরও কিছু দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগও তার। তার ছেলে শাহীন বলেন, চিকিৎসার জন্য বাবা আলম হাওলাদারকে নিয়ে ঢাকায় এসেছেন দ্বীপজেলা ভোলার বোরহানউদ্দিন থেকে। দেড় বছর ধরে জন্মদাতা বাবার দুটি কিডনিই নষ্ট। প্রতিনিয়ত বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ওষুধ।
তিন জনের প্রত্যেকেই বছরের পর বছর ধরে জটিলসব রোগে আক্রান্ত, চিকিৎসাও চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। কিন্তু এপর্যায়ে এসে সবারই যেন পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে। কিন্তু কেন? তাদের কাছে জবাব একটাই ওষুধের দাম বেড়ে গেছে।
স্কুল শিক্ষক রফিকুল ইসলাম জানান, সংসার ও দুই সন্তানকে পড়াশোনা করাতে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমার ওষুধের জন্য অনেক টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। স্কুল থেকে যে বেতন পাচ্ছি, তাই দিয়েই তো চলতে হয় আমাদের।
ষাটোর্ধ্ব জহিরুল হক বলেন, আগে বারডেম জেনারেল হাসপাতালে যে কোনো টেস্ট করাতে খুব কম খরচ লাগত, কিন্তু এখানেও খরচটা বেড়ে গেছে। খরচ বেড়ে যাওয়াতে আমাদের সমস্যা হয়ে গেছে। চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের। পেটে ভাত দিব না সুস্থ থাকার জন্য ওষুধ খাবো। দুটোই দরকার।
আলম হাওলাদারের ছেলে শাহীন বলেন, আমার আব্বার কিডনিতে সমস্যা, চোখে দেখতে পায় না, প্রেসার ও হার্টেরও সমস্যা আছে। বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয়। আমাদের মতো গরীব মানুষের এতো টাকা খরচ করার উপায়ও নেই।
চলতি বছরের মাঝামাঝি অত্যাবশ্যকীয় ৫৩টি ওষুধের দাম বেঁধে দেয় সরকার। এ তালিকার একটি বাদে সবগুলোর দাম বাড়িয়েছে একটি কোম্পানি। সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ বাড়িয়েছে তারা। ১৪টি ওষুধের ৪১ শতাংশ দাম আরেকটি নামি কোম্পানি বাড়িয়েছে। এছাড়া বাকি কোম্পানিগুলোরও একই অবস্থা।
সাধারণ ভোক্তার এমন আকুতির পরেও ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর সুরেই যেন সুর মিলিয়েছে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরও। প্রতিষ্ঠানটির দাবি, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় মূল্যসমন্বয় করা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধি নয়। অন্যদিকে, জনগণ বদলে কোম্পানির স্বার্থ সংরক্ষণকে বড় দায়িত্ব মনে করায় এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী সরকার বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
শাহবাগ মোড়ে এক ওষুধের দোকানি বলেন, প্রতিটি ফার্মাসিটিক্যালস তাদের উৎপাদিত জিনিসের ওপর দুই থেকে তিন শো পর্যন্ত লাভ করে থাকে। তারা যদি শতভাগ লাভ না করে ৫০ শতাংশ লাভ করত, তাহলে ওষুধের দাম কমে আসত।
এক ক্রেতা বলেন, কয়েকদিন আগেও যে ওষুধ ৬০০ টাকা প্যাকেট কিনেছি এখন সেটার দাম বেড়ে ৮০০ টাকা হয়ে গেছে।
আরেক দোকানদার বলেন, অনেক ফার্মাসিটিক্যালস ওষুধের দাম রাতারাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। জিসকা ফার্মাসিটিক্যালস যেমন ১০০টাকার ওষুধের দাম ১২০ টাকা করেছে, ৮টাকার টা ১০ টাকা করেছে। বেক্সিমকো সবার আগে যারা বাড়িয়েছে তাদের দেখাদেখি সবাই ওষুধের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদফরের উপপরিচালক মো. নুরুল আলম বলেন, আমাদের এখানে ওষুধের দামটা অন্য দেশের চেয়ে কোনোভাবেই বেশি নয়। যেভাবে বাজারমূল্য বেড়ে গেছে, সেই তুলনায় ওষুধের দামটা সমন্বয় করো হয়েছে। মূলত করতে বাধ্য হয়েছি।
স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, ওষুধের দাম বাড়ানোর বিষয়টি এখানেও একটি সিন্ডিকেট আছে। এখন ম্যানুফেকচারাস তারাই এ দামটা নির্ধারণ করে। ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রিশনের মাধ্যমে এ কাজগুলো করে নেয়। এখানে মূল দায়িত্ব সরকারের; ওষুধের দামটা কেমন হবে।
অত্যাবশকীয় ১১৭টির বাইরে ওষুধের দাম নির্ধারণে পূর্ণাঙ্গ কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের।