শনিবার , ০৫ অক্টোবর ২০২৪


শোয়েব চৌধুরী:
আজ মহান ২১শে ফেব্রুয়ারি যা দীর্ঘদিন ধরে শহীদ দিবস (শহীদ দিবস) নামে পরিচিত ছিল। বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা করার তাগিদ ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভক্তির পর থেকে শুরু হয়। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানি শাসকরা উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু দেশপ্রেমিক যুবকরা এই ঘোষণার সাথে একমত হননি। বিক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯৫২ তারিখে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভ বের করে। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালায় যার ফলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার এবং আরও কয়েকজন বিক্ষোভকারী সহ বেশ কয়েকজন প্রতিবাদকারী নিহত হন। সেই থেকে বাংলা ভাষার গৌরব সমুন্নত রাখতে জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বাংলাদেশে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। জাতিসংঘের শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (টঘঊঝঈঙ) ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর এই তারিখটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

২১শে ফেব্রুয়ারী যে কোন বক্তৃতা প্রদানের সময় একটি বিষয় বাধ্যতামূলক হয়ে আসে তা হল “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি” গানটি যা লিখেছেন প্রয়াত লেখক ও সাংবাদিক আব্দুল গাফফার চৌধুরী। গানটির সুর করেছেন আলতাফ মাহমুদ। আবদুল গাফফার চৌধুরী ও আলতাফ মাহমুদের স্মৃতিকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। যাইহোক, একটা বিষয় দেখে আমার কষ্ট হয় যে, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং আলতাফ মাহমুদ মনে হয় বিস্মৃতিতে পড়ে গেছেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯ মে ২০২২-এ মারা যান। তারপর থেকে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করার কাজ খুব কম  হয়েছে। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী তার বন্ধু ও তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিকুর রহমানের বাবা অধ্যাপক সাইদুর রহমানের পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির বাড়িতে বসে গানটি লিখেছেন। অধ্যাপক সাইদুর রহমান ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক।

আমি ১৯৯৬ সাল থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে নানাভাবে যুক্ত ছিলাম। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং তিনি আমার কাছ থেকে তথ্য ও পরিসংখ্যান নিতেন। কমনওয়েলথ বিজনেস কাউন্সিলের উপদেষ্টা হিসেবে অনেক তথ্য সংগ্রহ করতে থাকতাম। আমি ইংল্যান্ডে তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বাড়িতে গিয়েছিলাম এবং লন্ডনের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় আমরা ভালো সময় পার করেছি। তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি, তিনি ছিলেন আমার কাছে এক অনন্য বাতিঘর। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী দ্য এশিয়ান এইজের নিয়মিত কলামিস্ট ছিলেন।

আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন, বাংলাকে আমাদের মাতৃভাষা হিসাবে সুরক্ষিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সমস্ত ভাষা বীরদের স্মৃতি ধরে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এটি বলা যেতে পারে যে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সর্বদা স্বাধীনতা বিরোধী দলগুলির বিরুদ্ধে লিখতেন এবং তিনি ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে বাংলাদেশ সফর করেননি।

একটি নির্দিষ্ট মহল আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে পছন্দ করেনি যারা বর্তমানে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং ক্ষমতাসীন সরকারকে বিভ্রান্ত করছে।যার কুফল এখন দৃশ্যমান, এরমধ্যে আর্থিক খাতে অশনি সংকেত দৃশ্যমান 

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে নির্মিত সিনেমা ও অ্যাপগুলোকে একুশে ফেব্রুয়ারি, ভাষা শহীদ, ভাষা আন্দোলন, প্রয়োজনীয় নাম, জীবনী, ঠিকানা ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের সুবিধার্থে চালু করা যেতে পারে। এই ধরণের ডিজিটালাইজড তথ্যপূর্ণ ওয়েব পোর্টাল ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণ করতে এবং তাদের জন্য কাজটিকে সুবিধাজনক করার জন্য আন্তরিক করে তুলতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে।

তাছাড়া ভাষা শহীদ ও ভাষা আন্দোলনকারীদের জীবিত পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার আন্তরিক চেষ্টা করতে হবে। তাদের উন্নত জীবনযাপনের জন্য কোনো ধরনের সহায়তার প্রয়োজন আছে কিনা তা আমাদের খুঁজে বের করা উচিত।

একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বীর ভাষা শহীদ ও ভাষা আন্দোলনকারীদের ত্যাগের স্মরণ সবচেয়ে গৌরবময় দিন। এটা ছিল পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রথম বিদ্রোহ যারা আমাদের ওপর জোরপূর্বক উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা পারেননি মাটির অকুতোভয়, নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমে উদ্ভাসিতদের কারণে, যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নির্দ্বিধায় রক্ত ঝরিয়েছেন। ভাষা শহীদ ও ভাষা কর্মীদের সর্বোচ্চ আত্মনিবেদনের ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি বাংলা, আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা। আমরা আমাদের আবেগ, ভালবাসা, স্নেহ, প্রতিবাদ, সমবেদনা, ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিন্তা এই সুরেলা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করি। ১৯৫২ সালের ভাষা উত্থান আমাদের ১৯৭১ সালের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর প্রবেশদ্বার খুলে দিয়েছিল যার মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয়েছিলাম।

সারা বিশ্বের বাংলাভাষীদের মধ্যেও একুশে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষাভাষীরাও এই বিপ্লব দিবস পালন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, জার্মানি এবং বিশ্বের আরও কিছু অংশে বসবাসরত বাংলাভাষী প্রবাসীরাও দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে। এছাড়াও, সিয়েরা লিওন সরকার ২০২২ সালে বাংলা ভাষাকে তাদের দ্বিতীয় সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে বাংলা ভাষার এই অর্জনে আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত।

সর্বশেষে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম যার জোরালো ভুমিকা ১৯৪৮ সালে প্রাদেশিক পার্লামেন্টে বাংলা ভাষার দাবীকে জাতীয় দাবীতে পরিণত করেছিলেন। পাশাপাশি বিখ্যাত লেখক শহীদ জহির রায়হানের কথা যিনি তাঁর হৃদয়ে শিহরণ জাগানো বই আরেক ফাল্গুনের মাধ্যমে আমাদের ভাষা আন্দোলন ও এর প্রয়েজনীয়তা ফুঁটিয়ে তুলেছেন। আজকে ভাষা দিবস, শহীদ দিবস কিংবা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে তাদের প্রতি রইলো হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা।
 
লেখক: দ্য ডেইলী এশিয়ান এইজ পত্রিকার সম্পাদক বোর্ডের সভাপতি।   

 উপসম্পাদকীয় থেকে আরোও সংবাদ

ই-দেশকাল

আর্কাইভ