দেশে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। প্রতিদিনই রাজধানীসহ সারাদেশের কোথাও না কোথাও থেকে এমন খবর আসছে। গত এক বছর ধরে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনা বেশি ঘটছে। যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ভাবিয়ে তুলেছে। একইভাবে সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরও ভাবিয়ে তুলেছে।তারা বলেন, আমরাও আপারেশন করেছি-করছি, কিন্তু এমন ঘটনা তো ঘটেনি। অবশ্যই বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে অপারেশন ও চিকিৎসা সেবায় ত্রুটি আছে। এর কারণ উদঘাটন করতে হবে। নইলে দেশের চিকিৎসা সেবায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, রোগীরা বিদেশমুখী হয়েছে, আরও বেশি হবে। কতিপয় চিকিৎসক এবং সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ ও অবহেলায় রোগীর মৃত্যু কোনভাবেই কাম্য নয়। এদিকে ভুল চিকিৎসায় অহরহ মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত টিম গঠন করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অজ্ঞানকারী ওষুধের কারণে, নাকি চিকিৎসকদের গাফিলতি, নাকি অন্য কোন কিছু তা অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুসন্ধান টিম। তাদের রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে অধিদপ্তর।বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, দেশের বিপুল সংখ্যক রোগীকে সরকারের একার পক্ষে চিকিৎসা সেবা দেওয়া সম্ভব না। এ কারণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি চিকিৎসা সেবা থাকতে হবে। তবে সেবার মনোবৃত্তি থাকা বাধ্যতামূলক। মানসম্মত হতে হবে। সরকারের নিয়মনীতি মেনে পরিচালনা করতে হবে। সেই ব্যবস্থা না থাকলে অনুমোদন দেওয়া ঠিক হবে না। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করছে কিনা, আইসিইউ আছে কিনা, গাইডলাইন অনুসরণ করছে কিনা তা নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। যদি সব ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে তারা অপারেশন করতে পারবে না। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করা গেলে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর হার কমে আসবে। তারা আরও বলেন, বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য), সিভিল সার্জনদের নিয়মিত বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিকে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। এটা হয় না বলেই ব্যাঙের ছাতার মতো যেখানে-সেখানে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। দেশে বর্তমানে বৈধ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের চেয়ে অবৈধের সংখ্যা অনেক বেশি।ওটিতে হেঁটে গিয়েছিল শিশু তা?স?নিয়া, পরে নিথরদেহ পেল বাবা: কেরানীগঞ্জে ভুল চিকিৎসায় তাসনিয়া জাহান তনয়া (১২) নামের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রীর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মঙ্গলবার দুপুরে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় বসুন্ধরা আদ-দ্বীন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই ঘটনা ঘটে। তাসনিয়ার বাবা মনিরুজ্জামান জানান, তাসনিয়া সোনারগাঁও উদয়ন আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুলের ছাত্রী। আমার মেয়ের গত কয়েকদিন আগে পেটের ব্যথা হয়। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ দেয়া হলে ব্যথা কমে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায় তার অ্যাপেন্ডিসাইটিসের সমস্যা আছে। পরে অপারেশনের জন্য মেয়েকে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ হাসনাবাদের আদ-দ্বীন হাসপাতালে নিয়ে আসি। অপারেশনের জন্য দুপুর ২টার দিকে ও?টিতে হেঁটেই যায় তাসনিয়া। তিনি আরও বলেন, ওটিতে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পরেও মেয়ের কোনো খবর পাচ্ছিলাম না। পরে জোর করে অপারেশন থিয়েটারের ভেতরে প্রবেশ করে মেয়ের নিথর দেহ দেখতে পাই। এরা ভুল চিকিৎসা করে আমার মেয়েকে মেরে ফেলেছে, আমি এর উপযুক্ত বিচার চাই।শিশু মৃত্যুর ঘটনায় মৃতের পিতা মনিরুজ্জামান বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাত ১১ টায় বসুন্ধরা আদ-দ্বীন হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ শামসুদ্দিন আহমেদ, এনেসথেসিয়া বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ তাসফিয়া মাহমুদ, ডাঃ আজমেরী আলিম, ডাঃ নিহাল মোঃ ফাতিন ও হাসপাতালের ম্যানেজার মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে আসামি করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ এজারভুক্ত আসামিদের আটক করে বুধবার সকাল ১১ টায় রিমান্ড চেয়ে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠায়। দুপুরে চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাশফিকুর রহমান অভিযুক্ত ঐ পাঁচজনের রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর এবং জামিন মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেন বিচারক। এ ঘটনা নিহতের পরিবার ও মামলার বাদি হতাশা প্রকাশ করেছেন।ইবনে সিনায় সিজারের পর নারীর মৃত্যু, অবহেলার অভিযোগ পরিবারের: রাজধানীর কল্যাণপুরে ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসবকালীন অস্ত্রোপচারের পর ২৪ বছর বয়সী এক নারীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। স্বজনদের দাবি, চিকিৎসকের অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পলি সাহা (২৪) নামে ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বুধবার সকালে ইত্তেফাকের কাছে এসব অভিযোগ করেন পলি সাহার স্বামী আশিষ রায় ও তার স্বজনরা। মঙ্গলবার বিকাল ৪টায় কল্যাণপুর ইবনে সিনা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পলিকে মৃত ঘোষণা করে। স্বজনরা জানায়, গত সোমবার দুপুরে প্রসবজনিত অস্ত্রোপচার করাতে পলি সাহাকে ইবনে সিনা হাসপাতালে ভর্তি করান তার স্বামী। পেশায় ফার্মাসিস্ট আশিষ রায় বলেন, ‘সোমবার দুপুর ২টা ১৫ মিনিটের দিকে পলির সিজারিয়ান অপারেশন হয়। এরপর চিকিৎসক জানান, মা ও নবজাতক উভয়েই ভালো আছে। বিকাল ৫টার দিকে তাকে পোস্ট অপারেটিভ রুমে নেওয়া হয়। তখনো চিকিৎসকরা জানান, পলি ভালো আছে, তবে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। এরপর বিকালে চিকিৎসকরা জানান, পলির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে, তার জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। তখন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে পলির অবস্থা খুবই খারাপ। সে অক্সিজেন পাচ্ছিল না, তার হার্টবিটও পাওয়া যাচ্ছিল না। ওই সময় তাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, সোমবার সন্ধ্যায় দ্বিতীয় ধাপে পলির অস্ত্রোপচার করা হয়। সেই অবস্থায় তার আবারও হার্ট অ্যাটাক হয়, যেটা চিকিৎসকরা প্রথমে আমাদের জানায়নি। চিকিৎসকরা জানান, রোগীর জরায়ু কাজ করছে না, এজন্য ব্লিডিং হচ্ছে। তাকে বাঁচাতে হলে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। আমি আমার স্ত্রীর জীবন রক্ষার্থে সম্মতি দিলে অস্ত্রোপচার করা হয়। সোমবার রাত ৯টার দিকে চিকিৎসকরা জানায়, রোগীর ব্লিডিং কমেছে, কোনো শঙ্কা নেই। তবে ব্লাড প্রেশারটাও অনেক কমছে। দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচারের পর পলির সঙ্গে যখন আমার কথা হয়, তখন সে জানায়, তার অনেক রক্তক্ষরণ হচ্ছে, অস্থির লাগছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের এগুলো জানাতেই তারা জানায়, রক্তক্ষরণ কমে গেছে, ব্লাড প্রেশার নিয়ে তারা চিন্তিত। এরপর সোমবার রাতে আমাকে আর পলির সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি।’ আশিষ রায় বলেন, মঙ্গলবার ভোর চারটায় আমাকে জানানো হয়, পলির অবস্থা খুব খারাপ। তখন তাকে আবার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। মঙ্গলবার বিকেল চারটায় পলিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মঙ্গলবার সারা দিন চিকিৎসকরা পলির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানায়নি। আমি চিকিৎসককে ২০ বারের বেশি ফোন করেছি। তারা কিছু জানায়নি। দুপুর ১টায় আমাকে জানায়, রোগীর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, চিকিৎসকদের আর কিছুই করার নেই। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ জানিয়ে আশিষ রায় বলেন, পলির ?দুটি অস্ত্রোপচারেই প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। চিকিত্সকরা এটা বন্ধে পদক্ষেপ নেয়নি। তার বুকে ব্যথা ছিল, ব্লাড প্রেশার কমে যাচ্ছিল, এগুলোর জন্যও স্টেপ নেয়নি চিকিত্সকরা। প্রত্যেক জায়গায় গাফিলতি ছিল, তারা কেয়ার করেনি। এ ব্যাপারে ইবনে সিনা ট্রাস্টের জ্যেষ্ঠ সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. নূরে আলম সবুজ বলেন, এই ঘটনায় চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ভূল চিকিত্সায় রোগীর মৃত্যু সত্যিই দুঃখজনক ঘটনা। আগে কখনো ভুল চিকিত্সা ও অবহেলার অভিযোগে এতো মৃত্যু দেখিনি। এই ধরনের মৃত্যু রোধ করতে যা যা করার প্রয়োজন, তাই করবো। কারণ চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নেবো। কোন মৃত্যুই আমাদের কাছে কাম্য নয়।